গুটি গুটি পায়ে লুকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রথমা।
মা-কে কোনোরকম ডাক দিয়ে বললো,
মা আমার ফিরতে একটু বিকেল হবে। আপনি খেয়ে নিবেন, কেমন? বলেই দৌড়। দেরি করলেই রাজ্যের প্রশ্ন করবেন মা।
বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সা করে চললো ফুলের দোকানে। দুটো হলুদ গোলাপ আর একটা অর্কিড কিনে নিলো। একটা গোলাপ নিজের ব্যাগে রাখলো। বাকি দুটো একসাথে হাতে মুঠ করে নিলো। প্রথমা হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তির নি:শ্বাস নিলো।
-সুবহানআল্লাহ। আকাশটা আজ একটু বেশিই সুন্দর
হেটে হেটে গলির মাথা পর্যন্ত গেলো। এবার কিছুক্ষণ অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা করতে তার খারাপ লাগেনা একদমই।
অপেক্ষা করতে করতে হাতের ফুলগুলোকে একটা সুতা দিয়ে বেঁধে নিচ্ছে, যেনো ধরতে অসুবিধা না হয়।
ঠিক ২:৩০টা বাজে মসজিদ থেকে মুসল্লিরা বেরোচ্ছে জুমার নামায শেষ করে। এই মসজিদের মুয়াজ্জিন খুব মায়া মিশিয়ে আজান দেন। একদম মনে গিয়ে ধরে। প্রথমা মসজিদের একটু পাশে গিয়ে আড়ালে দাড়ালো, যেনো তাকে না দেখা যায়। সবার প্রস্থান শেষ।
ওর অপেক্ষার পালাও শেষ। প্রথমার বুকটা ধুকপুক করছে। খুশিতে নাকি অন্যকোনো কারণে বুঝতে পারছেনা। যাই হোক। জলদি কাজ শেষ করে বাসায় যেতে হবে।
মসজিদের গলি থেকে বেরিয়ে পাশের কবরস্থানের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
নাম- আঞ্জুমান নগর পারিবারিক কবরস্থান। গেইটটা খুলে সামনের রাস্তা পেরিয়ে ৩ নম্বর কবরের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
পড়লো ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া আহলাল কুবুর।’
কবরের নেইমপ্লেটটা একটু পরিষ্কার করলো টিস্যু দিয়ে। কোত্থেকে যেনো লাল গোলাপ ফুটেছে কবরের ওপর। প্রথমা কিছু সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।
নীরবতা ভেঙ্গে প্রথমা বললো,
-আপনি মনে হয় আমাকে ছাড়া একটু বেশিই ভালো আছেন। গোলাপটা যেভাবে ফুটেছে!
-আমি কিন্তু বাসা থেকে অজু করেই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। বকা দিবেন না প্লিজ!
-আম্মা আপনাকে আজকেও স্বপ্নে দেখেছে। আপনি নাকি আলুভাজিতে লবণ বেশি হওয়ার পরও হাসিমুখে তা খেয়ে যাচ্ছেন। আম্মাকে বোঝাতেই পারিনা, যে তার মানে আপনি ভালো আছেন। আপনিই তো বলেছেন, মৃত মানুষ স্বপ্নে হাসি দিয়ে থাকা মানে সে ভালো আছে।
হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো সে।
-আমার এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে বলতে পারেন?
হলুদ গোলাপ আর অর্কিড ফুলগুলো রাখতে রাখতে, প্রথমার চোখ ভিজে উঠলো। মনে পড়লো, তার দুটো পছন্দের ফুল তিনি রোজ বাসায় আসার সময় নিয়ে আসতেন।
মসজিদের মাইক থেকে আজান ভেসে আসছে। হাইয়া আলাল ফালাহ।
প্রথমা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাড়ালো। আসর এর সময়। মুসল্লীরা আসা শুরু করবে এখনই। আরো কিছু সময় থাকতে ইচ্ছে করছে। যেতে হবে ভাবতেই তার বুকের ভিতর একটা সুক্ষ্ম ব্যথা লাগলো।
যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকালো, কবরের ওপর লাল গোলাপটাই চোখে পড়ছে বারবার।
বিকেলের আকাশটা একটু বেশিই সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় কিছু সময়গুলোকে থামিয়ে দেয়, যাতে আমরা আরেকটু অপেক্ষা করি। কিছু অপেক্ষার প্রহর বিষাদের, তবুও সুন্দর।
-আম্মার জন্য একটা লাল গোলাপ নিয়ে যাবো।
লেখাঃ জেরিন আঞ্জুম প্রভা