একটি দিনের অপেক্ষা আর অপেক্ষার অবসানে

এখনো মুখোমুখি হয়নি দুজন। তবে কথা শুরু হয়েছে। হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। কত কথা জমে আছে না! বুকের মাঝে। বেদনার পাহাড় এক গড়ে উঠেছে যেনো। আলোকিত দিনের মাঝে ও পুরাতন একটা অধ্যায় যেনো মনের মাঝে আসন গেড়ে রয়ে গেল। এর অবসান চায় সে। চায় একবার,অন্তত একবার দেখা হোক তার সাথে। শিউলির গন্ধ মাখা শৈশবে তার ধূলো মাটির  ফিরনি পোলাও নিয়ে মজা করতো যে মানুষটি, আর একটু বড় হলে ভালো লাগার কিঞ্চিৎ অনুভব তাকে অন্য একটা জগতে টানছিল যেনো।

পায়ে পায়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে তারা। বলতে গেলে পথের শেষ প্রান্তে। উনিশো তেয়াত্তরে দেখা হওয়ার কথা ছিলো। মুনালিসার বয়স তখন কত ছিল? কুড়ি /একুশ। গ্রেজুয়েশন শেষ করে সে ঢাকায় এসেছিলো। আর বিএফ এর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাবেরিন আলী, মামাতো বোন মুনালিসার চেয়ে বয়সে কি খুব বড় ছিলেন! মুনার তা মনে হয় না। সাবেরিন আলী যখন মুরারী চাঁদে ইন্টারের ছাত্র মুনালিসা তখন ঘটিবাটির রান্নাবাড়ি খেলা ছেড়ে লুডু এক্কাদুক্কা,ফুলগুটি,কড়ি, মারবেল,ক্যারাম এসব খেলায় আসক্ত হয়েছে। পাড়ার বান্ধবীদের সাথে খেলা জমে উঠতো। কাউকে না পেলে ভাইদের খেলায় ঢুকে যেত। ছোট বোনদের  সংগেও খেলতো। সাবেরিন আলী তখন ঘনঘন আসতেন ছোট মামার বাসায়। থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। ঈদগা রোডে এমসি কলেজের সেই বিখ্যাত টিনসেড ছাত্রাবাস,কত কীর্তিমানের স্মৃতি ধারন করে আজও দন্ডায়মান আছে সে। মুনালিসার বড় বোন রওশন ঐ কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বুবু ছুটিতে বাড়ি এলে  তার সাথেই জমে উঠতো সাবেরিন আলীর গল্প তারুণ্যে ভরপুর মানুষটা বাড়িতে এলে শিউলির গন্ধ এসে মনটাতে দোলা লাগিয়ে যেতো মুনালিসার।  অথচ তখন শিউলি ফোটার সময় ছিল না। তখন সে কিশোর বয়সের ছোঁয়া পেয়েছে। একেবারে যে কথা হত না তাদের মাঝে তা নয়। স্মার্ট সুন্দর তরুনটি ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া ফুটফুটে মামাতো বোনটিকে সামনে পেলে বলতেন -কেমন আছো তুমি। ভীষন লাজুক কিশোরী লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিত। মাখনের মতো নরম দেহ বল্লরী লজ্জায় মিইয়ে যেতে চাইতো যেনো। পুতুল পুতুল মুখাবয়ব। মাথা নিচু রেখেই বলতো- ভালো আছি। -তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে?  না, সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনা ঠিক চলছে তো? সাবেরিন আলীর তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে সে হা সূচক মাথা নাড়তো। বড় বোন রওশন এ আলাপচারিতায়  মিটি মিটি হাসতো আর বলতো-সাবেরিনও খুব লাজুক। তোমাকে দেখলে আরো গুটিয়ে যায়। কেন? বলতো? সাবেরিন আলীর মুখে ও মিটিমিটি হাসি। বীরপুরুষের মতোই তাঁর কন্ঠ তখন। কোনো রকম হেয়ালি ছাড়াই বলতে শোনা যেতো-,কী জানি রওশন আপা!কেন যে আমাকে এত ভয় করে পিচ্চিটা। আমি যেনো ওর কাছে বাঘ ভালুক কিছু একটা।

একেবারে বাহাদুরের মতো কথা। পিচ্চি শব্দটার মধ্যে যেনো একগাদা অপমান তার জন্য। বিচ্চিরি লাগে তার শব্দটা। তবু কিছু বলতে পারতো না। বড় বোনের উপর,ফুফুর নন্দনের উপর চাপা রাগ নিয়ে পায়ে পায়ে সে এ ঘর ছেড়ে যেত। আবার কোনো কোনো দিন মায়ের ডাক পড়তো ও ঘরে চা নাস্তা পৌছে দেয়া।  অনীহার অতলে ইচ্ছে ও তাকে প্রবল ভাবে ঠেলে নিত। একজোড়া চোখ তাকে অবলোকন করতো। কিন্ত সে কখনো পারেনি ঐ চোখের সাথে চোখ মেলাতে। অথচ এ বয়সটা। এই কিশোর বয়সেই বুঝি মানুষ রাজপুত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়। সেও কি হয়নি। হয়েছিল। মনেমনে স্বপ্ন বুনেছিল। কাউকে বলতে পারেনি কিছু মনের জড়তা কাটিয়ে। কথা যে তাদের মাঝে একেবারেই হয়নি, তা নয়। এমন করেই হয়েছে টুকটাক কথা অনুরাগে বিরাগে। এর কোনো উন্নয়ন ছিলো  না। সাবেরিন আলীর ইন্টার কাশের পড়া শেষ হলে কনা ফুফু এলেন বেড়াতে। তার আগে একদিন বড়বোন রওশন তাকে আক্রমণ করলেন- তুই সাবেরিনের সাথে কথা বলিস না কেন?ওকে দেখলে কেন পালিয়ে যাস!ও তো তোর সাথে কথা বলতে চায়। বড়বোন বললো-ঠিক আছে। কথা যদি না-ই বলতে পারিস তো তুই চিঠি দিস তাকে। ক্যামন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গ্যাছিলো সেদিন বড়বোনের কথা শুনে। চিঠি লিখবে!যাকে দেখলে এত লজ্জা পায় তাকে আবার চিঠি লিখতে হবে। চিঠিতে সে কি লিখবে! বড় বোন তো তা বলে দিল না। চিঠি লিখা শিখেনি তখনো সে। বোনকে সে কথাটা ও বলতে পারলো না।

এমন অনেক কষ্ট তাকে আজ ও পীড়া দেয়। বাহাত্তর বছরের জীবন খাতার পাতা উল্টাতে থাকে সে। এর প্রতিটি অধ্যায়ের কথা তার মনে আছে। কোনো কিছুই ভুলেনি সে। জীবনে আরো কতকিছু ই তার পাওয়ার ছিল। তাঁর লজ্জা, তার বিনয় তার ভীতি,সিদ্ধান্ত হীনতা এতকিছু মিলেই তো অনেক কিছু থেকেই তাকে বঞ্চিত করে দিয়েছে। হায় আফসোস। কেবল ছেলেবেলার ভুল নয়, বড় বেলাও সে ভুল করেছে।  আর তাই বুঝি এই করেছো ভালো নিঠুর, এই করেছো ভালো ,  এমনি করে হৃদয়ে মোর দুখের দহন জ্বালো । ঠিক দহন নয়, কিছু কষ্ট, কিছু কান্না, কিছু অভিমান,কিছু হতাশা নিয়ে সে প্রায়ই গুনগুন করতো এমন গানের কলি। তার এ গুনগুনানির খবর জগৎ সংসারের কেউই জানতো না। অনেক সময় নিজের অজান্তে ই তার মন জুড়ে গুনগুণিয়ে উঠেছে এ গানের কলিদুটো। তার মন বলতো,আর একবার দেখা হউক। ফিরে দেখা। আর সে দেখায় সে যেনো জানাতে পারে, কৈশোরে  সে শিউলির গন্ধ পেয়েছিল কোনো এক রাজপুত্রের মাঝে। সেই একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলো সে। তার সাথে আবার ফিরে দেখা হবে- সেই অপেক্ষা। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল কেবলই। তাই মাঝে মাঝে হতাশা তাকে ঝাপটে ধরেছে। হয়তো আর দেখা হবে না কখনো কোনোদিন। হয়তো সে বেঁচে নেই। তার দেখা পেলে জিন্দাবাজার লেনের  সেই শিউলির গন্ধ মাখা শৈশবে সে আর একবার ফিরে যেতে পারতো, হয়তো বা। কোকড়ানো চুল, হাসলে দুগালে টুল পড়তো যে মেয়েটির। উঠোনের কোনে শিউলি গাছটাতে প্রচুর ফুল ধরতো আর ঝরতো। গাছতলা তখন ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যেতো। ফুল কুড়ানোর তাগিদে মুনালিসার ঘুম ভাঙতো কাক ভোরে। বাবা মসজিদে নামাজ শেষ করে ঘরে ফিরলে মুনালিসা বাবা-র হাত ধরে শিউলিতলায় যেতো। প্রতিদিন সে মালা গেঁথে আনন্দ পেত। সে বয়স টা একা একা আনন্দ পাওয়ার ই বয়েস ছিল।  তারপর একটু একটু করে বড় হলো, প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়,ভালো লাগা এলো। ভালো লাগলো  সাবেরিন আলীকে, তার ফুফুর ছেলে। তাকে কিছু বলা হলো না। সে ও তো কিছু বললো না। বড় বোন ও আর কিছু বললেন না। কিছু না বলে ই বড় বোন বাড়ি ছাড়লেন। তার বিয়ে হয়ে গেল। তখন সে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৈশোরের ভালোলাগা ভেতরে একটা কষ্টের জন্ম দিল। কাকে বলবে, বলতে তো পারবে না। সে আর আসে না। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে সে ও চলে গেছে। বাবার মুখেই শোনা যেতো তার কথা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে। ইকনমিক্সে। ভালো সাবজেক্ট। বাবা গর্বিত হতেন ভাগনের কৃতিত্বে।

পরের ঘটনা দ্রুত ঘটে গেলো। ফুফু এসেছিলেন। ফুফু তাকে চুমো খেলেন কয়েকবার। বুকে টেনে নিলেন। ফুফুর বুকের নিবিড়ে, স্নেহের আতিশয্যে বিগলিত হয়ে যাচ্ছে সে। ফুফু বাবাকে বলছেন-হুরু ভাইসাব,এই লক্ষী মেয়েটাকে আমাকে দেন। আমার সাবেরিনের সাথে মানাবে খুব। ফুফু নিজের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে পরাতে যাচ্ছলেন মুনালিসার আঙুলে। বাবা কিছু বলার আগেই ত্বরিত গতিতে কোথা থেকে যেনো এসে পড়লেন মা। বাবা কে কিছু বলার সুযোগ  না দিয়ে নিজেই বললেন-ভাগনে তো কুটুম ই আছে। তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে আবার আত্মীয়তা করতে যাব কেন? এটা হবে না। মেয়ের জন্য আমি অন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি। চিরকালের নিরীহ বাবা চুপ করে গেলেন।

ফুফুর সাথে সেটাই তার শেষ দেখা ছিলো। ফুফুর ছেলের সাথে ও আর দেখা হয়নি। ফুফার মৃত্যুর খবরে মা অবশ্য ছুটে গিয়েছিলেন। বাবা রিটায়ার্ড লাইফে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে সকালের সোনা রোদ পোহাতেন। বিজ্ঞানের ছাত্রী মুনালিসাও অদূরে মাদুর পেতে বসে ইন্টার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। বাবা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, ইকনোমিক্সের মতো ভালো সাবজেক্টে চান্স পেয়েও পড়াটা ধরে রাখতে পারল না সাবেরিন। নিজের পড়া থামিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছিল মুনালিসা।

-কেন বাবা? সহজ সরল প্রশ্ন ছিল তার। কিন্তু ভেতরটা নড়ে উঠেছিল। আর ভাবছিলো, বাবা কেন তাকে শুনাচ্ছে আবার ও তার কথা। যা চুকে বুকে শেষ হয়ে গেছে কৈশোর না পেরোতেই আবার সেসব টেনে এনে কি লাভ!

তোমার ফুফার দুরারোগ্য ব্যধির ট্রিটমেন্টে পরিবার একেবারে নিস্ব হয়ে পড়েছে। ধোৃপা দিঘীর পারের সুন্দর বাড়িটা  বিক্রি হয়ে যাবে। তোমার ফুফু আপাততঃ গ্রামে থাকবে। ছোটদের নিয়ে।

তার চোখে পানি জমেছে। ঝরতে দিল না। উর্ণার আঁচলে মুছে নিল চোখ। বাবা যেনো তাকে আস্বস্ত করলেন, পরবর্তী বাক্য দিয়ে।

সাবেরিন চান্স পেয়েছে পিএফএ। চলে যাচ্ছে করাচিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি টা হলো না -এই আর কি। আবারো খানিকটা হতাশ বাবা।

এটা ১৯৬৭ সালের কথা। তারপর কতদিন গেল। আর কোনো খবর জানে না মুনা।

স্বাধীনতার পরপর করাচি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তার ফুফুতো ভাই সাবেরিন আলী। জয়েন করেছিলেন বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সে। এনগেজমেন্টের পর মুনালিসার বিয়ে ভেঙে গেল। বাবা মন খারাপ করলেন না। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ছেলেটাকে তার মোটেই ভালো লাগছে না। বাবা হয়তো মেয়ের পাশে তার ভাগ্নের ছবি ই দেখছিলেন। মুনালিসা খুব কান্নকাটি  করছিল। মা-র নির্বচিত পাত্র আর্মির ডাক্তরের  একটা আন্ডার স্টান্ডিং আছে। মুনালিসা কে সে শাডিয়ে চিঠি দিয়েছে। মুনালিসা অপমানে কেদেছিল। বাবা বলেছিলেন- আগে নিজের পায়ে দাড়াও। তোমাকে ঢাকায় যেতে হবে। সাবেরিন তোমার এডমিট কার্ড পাঠিয়েছে। তুমি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ইন্টারভিউ দেবে। বিএড নিয়ে সরাসরি সরকারি স্কুলে ঢুকবে। এটা আমার স্বপ্ন। তোমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেসেরও ইচ্ছে। সব ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন।

সেটা ছিল ১৯৭৩। বাবার কথা সে বিনা দ্বিধায় গ্রহন করেছিল। বাবার পেশা গ্রহন করে বাবাকে মর্যাদা দিতে চায় সে। বাবা তার হাতে ডাকে আসা এডমিট কার্ড আর একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। চিরকূটে লেখা ছিল,
মুনালিসা, তোমার বিএড এ ভর্তির এডমিট কার্ড পাঠালাম। আমি তোমাকে এয়ার ফোর্সে কোনো জবে ঢুকাতে পারতাম। কিন্ত মামার ইচ্ছে  তুমি তার মতো আদর্শবাদী শিক্ষক হও। সেটাই ভালো। তুমি ঢাকায় চলে এসো।
ইতি-সাবেরিন আলী।

এক অযাচিত আনন্দে তার মন নেচে উঠৈছিল সহসাই, তার সাথে দেখা হওয়ার প্রত্যাশায়। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুনালিসার মনে হয়েছিল, সে জীবনের এক ধূসর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। সেখানে তার ফুফুত ভাই তাকে পথ দেখাতে এসেছেন। তার উপর সে আস্হা রাখতে পারে। ভীরু দুর্বল মেয়েটি সহসাই সাহসী হয়ে উঠেছিল। মার শত বাধা সত্বেও এনগেজমেন্ট রিং খুলে রেখে সে ঢাকায় এলো। সাথে এলেন মা।

তেয়াত্তরের ঢাকা তখন কত ছোট, কত নিরিবিলি, তবু তার দেখা হলো না। বাবা একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেই ঠিকানায় তার খুঁজে এসেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাবেরিন আলী। কিন্ত মা তখন মুনালিসা কে নিয়ে অন্য ঠিকানায় চলে গেছেন। পরপর দুবার এসেছিলেন তার ভাই. দুবারই সে মতিজিল টিএনটিতে নেই। পরে এ খবর জেনে ভাগ্যকে দোষারোপ করেছিল মুনালিসা। ভবিতব্যের এ কি খেলা। খুব কি ক্ষতি হত কারো যদি তাদের দেখা হত! মুনালিসার বিশ্বাস ছিল, এ অদৃষ্টের ই খেলা। কৈশোরে যাকে ভালো লেগেছিল আজ নাহয় যৌবনের পরিপূর্ণ দৃষ্টি তে তাঁকে দেখে সে পরিতৃপ্ত হত।

সেবার সে ঢাকা বিএড কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। মা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সে ফিরেনি। মা বলেছিলেন, বন্দি বিনিময় হলে ক্যাপটেন মুরাদ ফিরবেন। এখন তো তিনি বন্দি পেশোয়ারের সাগাই শিবিরে। সব ঠিক হয়ে যাবে। মুনালিসার বিয়ে তার সাথেই হবে।

মুনালিসা ফিরেনি। জীবনের দিক আবার পরিবর্তন হয়েছে। বিএড এর পরিবর্তে সে ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনো না কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে যেতে পেরেছে সে। কেউ একজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল

সে হাত শক্ত করেই ধরেছিল। প্রতিষ্ঠিত জীবনে পথ চলতে চলতে সে কিন্তু ভুলে যেতে পারেনি তার অতীতকে। একজন সাবেরিন আলী কে। উত্তর বংগে সংসার সাজালেও পূর্ব বংগের মেয়ে যখন যেভাবে পারে খুজেছে একজন সাবেরিন আলীকে। তার ফুফুর পুরো পরিবার কে। সিলেট শহরের ধোপা দীঘির পারের বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। কতভাবে পরিচয় দিয়েছে সে। কেউ বলেছে -ওরা দেশে নেই প্রবাসে।

হতে পারে। আশ্চর্যের কিছু নেই। হয়তো তারা সবাই প্রবাসে। সাবেরিন আলী নামে একজনের অস্তিত্ব যেনো তার হৃদয় মনে জড়িয়ে আছে। দেখা হলে একবার অন্তত সরি বলতো তাকে। আর কিছু না বলুক।

স্বামীর মৃত্যুর পর আর একবার তার জীবনের রুটিন বদলে গেল। উত্তর বঙ্গ  ছেড়ে আবার ষে ঢকায় ফিরল। আবার নতুন করে আশাবাদী হল।

এবার সে ফেইসবুকে সার্চ দেশে। এ নামে হাজার জন হাজির হয়। একবার সৈয়দ যোগ করে। ফুফাতো সৈয়দ ব্যবহার করতেন। পায় না। আবার বাদ দেয়। ছবি দেখেও চেনার নয়। কে জানে দাড়ি রেখেছেন কিনা। ক্রমশ ই হতাশ হয়। অবশেষে পায় এক সাবেরিন আলীর ফোন নাম্বার। এয়ার কমডোর সাবেরিন আলী। অন্ধকারে ঢিল দেয়ার মতো কল দেয়। রিং হয়। হ্যালে বলতেই সে জানতে চায়-আপনি কি সাবেরিন আলী?,

-বলছি, তুমি কে?আমি কি চিনি তোমাকে?

এক সময় চিনতেন। এখন মনে করতে পারেন কি না,জানিনা। আমি মুনালিসা। আপনার মামাত বোন মুনালিসা। জিন্দাবাজারের মামার মেয়ে।

এতসব বলে থেমে যায় সে। এবার যদি না চিনেন তবে ফোন রেখে দেবে, এমনটি ভাবে। কিছক্ষণ কথা নেই। অনেক পেছনে হেঁটে যাচ্ছন মনে হচ্ছে। স্মৃতির বালুবেলা থেকে কী কী যেনো কুড়িয়ে এনে বললেন -তুমি খুব সুন্দর ছিলে না?

সে বললো- আমি আজো সুন্দর আছি।

তাই। হাসলেন সাবেরিন আলী।

হোয়াটসঅ্যাপ যে নিজের একটা ছবি পাঠায় মুনালিসা, দেখেন চিনতে পারেন কি না? ছবির নিচে মুনালিসা লিখে আবার পাঠিয়ে দেন সাবেরিন।

চিনতে পেরেছেন তাহলে। বুকের ভেতরে আনন্দের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয়।

নিজের ছবি পাঠিয়ে সাবেরিন আলী লেখেন- আমাকে দেখ। আমাকে কি চেনা যায়?

খুব চেনা যায়। এখনো এত সুন্দর! তিরিশে আটকে আছেন যে।

থাকলে কি! তোমার ভাবী তো ছেড়ে গেছেন আমাকে।

সে কি? আপনি একা!হ্যাঁ। তার ক্যানসার হয়েছিল। চার বছর আগে চলে গেছে।

মুনালিসার মন খারাপ হয়ে যায়। এমনটি তো সে ভাবেনি।

তুমি কেমন আছ? তোমার স্বামীর কি করেন।

-সে নেই। উনিশ বছর আগে চলে গেছে।

আমরা দুজন তাহলে সম্মৃতির সমাধিতে বসবাস করছি।

মুনালিসা বললো -হ্যাঁ।

আমার আপনাকে অনেক কথা বলার আছে, মুনালিসা বললো

-আগে বলোনি কেন? অসময়ে বলে লাভ কি?

ভালোবাসা লাভ ক্ষতির ধার ধারে না। তার কোনো সময় অসময় নাই।

যদি তাই হয় তবে শুনবো। আমাদের ভবিতব্য এক। তুমি একদিন এসো। ঠিকানা দিয়ে দেব। তুমি তখন খুব ছোট ছিলে। তাই কোনে কথা বলা হয়নি।

২০২৩ অনেক কিছুই নিয়ে গেছে জীবন থেকে। কিন্তু এমন কিছু দিয়ে গেল যা তার বহু প্রতিক্ষিত। মুনালিসা ভাবে। দেখা হওয়ার তাগিদ খুব বেশি নেই তাদের। প্রেম নয়, ভালোবাসা। দুজনের জন্য দুজনের। সাবেরিন শুনতে ভালোবাসেন। মুনালিসা বলতে। দুজনের ই ছেলেমেয়ে বাইরে। নিসংগ জীবনে বিধাতাই বুঝি কাছাকাছি এনে দিলেন দুজনকে।

সাবেরিন শুনতে ভালোবাসেন আর মুনালিসা বলতে। কথা সাহিত্যিক মুনালিসার অনেক কথা আছে। অতীত থেকে তুলে আনে বেশি তার। সাবেরিনের মতে-তোমার কবিত্ব বেশি ভালো লাগে। ছোট ছোট বাক্য মনটা ভরে তোলে। মুনালিসা বলে-আমি সার্থক।  সাবেরিন বলেন-নিজেকে যোগ্য করে তুলেছো। কবে থেকে লিখলে? মুনালিসা বলে-যেদিন আপনি চলে গেলেন জীবন থেকে। সাবেরিন এর জবাব দিতে পারেন না। মুনালিসা তবু বলতে থাকে।

লেখাঃ আমেনা আফতাব

Scroll to Top