প্রাইমারী স্কুলে অধ্যয়নকালীন সময়ে বাসায় সময় কাটানোর জন্য কোন সঙ্গ ছিলো না আমার। মা-বাবা দু’জনেই কর্মস্থলে যেতেন।আর কাজের মেয়ে রাখা হলেও বেশ কয়েকবার বদলাতে হয়েছে বিবিধ কারণে। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে কতক্ষণই বা সময় কাটানো যায়!
তাই স্কুলে আমার একটা ইচ্ছা ছিলো যে, প্রত্যেক সপ্তাহান্তে স্কুল শেষে আমার বান্ধবীদের আমার বাসায় আমন্ত্রণ জানানো। বান্ধবীদের কেউ কেউ আসতে চাইতো না। আবার কেউ বাসায় এসে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে তাদের বাসায় চলে যেতো।
তাই এক বৃহঃস্পতিবার আমি আমার বান্ধবী রুম্পাকে স্কুল শেষে আমাদের বাসায় আমন্ত্রণ করেছিলাম।
বৃহঃস্পতিবার দুইটা ক্লাস হওয়ার পর সাংস্কৃতিক ক্লাস ও অনুষ্ঠান হতো বলে ক্লাসের উপস্থিতি অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশী থাকতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগে ৩০ মিনিটের বিরতি থাকতো।আমার বাসা স্কুলের নিকটবর্তী হওয়ায় আমি সেই সময়ে বাসায় এসে গোসল করে স্কুলে যেতাম। রুম্পাকে বলেছিলাম যে সে যেন তার পরিবারের কাছে আমার বাসায় নেমন্ত্রণের বিষয়টি জানায়।
বাসায় এসে গোসল সেরে আধ ঘন্টা পর স্কুলে গেলাম। নির্ধারিত সময়ে সাংস্কৃতিক ক্লাস ও অনুষ্ঠান শুরু হলো।আমার কাছে এই ক্লাস ও অনুষ্ঠানটা বেশ ভালো লাগে। যে যার পছন্দমতো নাচ, গান, আবৃত্তি, কৌতুক, উপস্থিত বক্তৃতা পরিবেশন করতে পারে। আমি কবিতা আবৃত্তি পাঠ করেছিলাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হলে রূম্পাকে বলি , -তুমি যে আমার বাসায় যাবে সেটা তোমার বাসায় বলেছো ?
রূম্পা মাথা নিচু করে বলে , -হুম, আমার বাসায় জানিয়ে এসেছি যে তোমার বাসায় যাবো ।
আমি রূম্পাকে নিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে এলাম।
বিরতিতেই আম্মুকে বলে রেখেছিলাম রুম্পাকে বাসায় আনার কথা। আম্মুও তাঁর কর্মস্থল থেকে দুপুর ২:০০ টায় চলে আসে।
ডাইনিং টেবিলে সবজী ভাজি, করলা ভাজি, শাক, মুরগির মাংস, ডাল ইত্যাদি নানা খাবার দিয়ে পরিবেশন করা হয়। আমি রূম্পাকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসি। খাবার খাওয়া শেষে আমরা টিভি দেখি।
আমি রূম্পার সাথে আড্ডা ও গল্পগুজবে মেতে উঠি।বিকেলে রূম্পাকে নিয়ে বাসার বাইরে গলির মোড়ে খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ হাঁটি। কখন যে বিকেল গড়িয়ে গোধূলিকাল উপস্থিত হলো, টেরই পায়নি। খেয়াল করলাম, বাড়ী ফেরার জন্য রূম্পার কোনো তোড়জোড় নেই। বলতেও সংকোচ হচ্ছে। তবুও রূম্পাকে বললাম, -সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ।তোমার বাড়ী যেতে অসুবিধে হবে না ?
রূম্পা চুপ করে রইলো। কোনো কথা বললো না। মাগরিবের আযানও দিয়ে দিলো। আমরা বাসায় এলাম। রূম্পাকে আবার জিজ্ঞাস করলাম, -রাত হয়েছে ,তোমার মা তো চিন্তা করবে। তুমি বাসায় জানিয়ে এসেছো তো ?
আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। আম্মুকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললাম, -রাত হয়ে গেছে। রূম্পা সেই কখন এসেছে। এখন তার বাসায় না গেলে তো তার পরিবার চিন্তা করবে।কী করা যায় ?
আম্মু বললো, -সেটাই তো। মেয়েটা অনেকক্ষণ আমাদের বাসায়। তার বাসায় একটু জানানো দরকার। তোমার বাবাও তো এখনো অফিস থেকে ফিরেননি। বুঝতে পারছি না কী করবো ? তোমার বাবা আসুক পরে দেখি কী করা যায়।
আসলে তখন তো মোবাইল ফোনের চল সবে মাত্র চালু হয়েছে। খুব কম মানুষের বাসায় ফোন থাকতো। তাই রূম্পার বাসায় যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিলো না। আমরা এতো চিন্তায় মশগুল কিন্তু রূম্পার মধ্যে চিন্তার লেশমাত্র নেই! কিছুক্ষণ পর বাবা বাসায় ফিরলেন। বাবাকে সব বিষয় জানালাম।
দেখতে দেখতে রাত ৯:০০ টা। বাবা বললেন, -এখন এতো রাতে রূম্পার বাসায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। সকালে রূম্পাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো,কেমন!
আমি বললাম, -হুম,সেটাই ভালো হবে।
রূম্পা আমাদের সাথে ডিনার করলো। তারপর আমার রুমে রূম্পা আমার সাথে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সকাল ৭:০০ টায় ঘুম ভাঙ্গলো। আজ শুক্রবার হলেও স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠান আছে। উঠে দেখি পাশে রূম্পা নেই। বাবা নিশ্চয়ই রূম্পাকে তার বাড়ী পৌঁছে দিয়েছে। পরে দেখি ড্রয়িং রুমে রূম্পার বাবা স্বয়ং হাজির। আসলে আমার বাবা স্কুলের প্রশিক্ষক হওয়ায় আমাদের বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি।
আমার বাবা রূম্পার বাবাকে বললেন, -রূম্পা তো প্রিয়ন্তুকে (আমি) বলেছে যে সে বাসায় বলে এসেছে।কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় আর বাসায় ফেরার রিস্ক নেই নি।”
রূম্পার বাবা জানালো, -হুম ,রূম্পা তার মা-বোনকে জানিয়েছে ঠিকই। কিন্তু একটা বিষয়ে একটু খুনসুটি হওয়ায় রূম্পা বাসা থেকে অভিমান করে আপনার বাসায় এসেছে।
বাবা বললেন, -আমার মেয়ে একটু পরই স্কুলে যাবে।রূম্পাও পিয়ন্তু এক সাথেই স্কুলে যাবে না হয়।
রূম্পার বাবা বললেন, -রূম্পার মা রূম্পার পথ চেয়ে বসে আছে। রূম্পার উদ্দেশ্যে বলেন, -চল্ মা, সব অভিমান ভুলে বাড়ীত চল্। তোর মায়ে তোর লাইগ্যা বইয়্যা রইছে।”
রূম্পা তার বাবার সাথে আমাদেক বাসা থেকে বের হলো। চলার পথে আমাকে বললো, -প্রিয়ন্তু আসি ।স্কুলে দেখা হবে।
আমিও বললাম, -ঠিক আছে। আবার এসো। স্কুলে দেখা হবে।
আমার বাসায় রূম্পার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো সত্যিই আনন্দময় ছিলো।