-আপনি কি কবিতা লিখতে জানেন?
মেঘকে হঠাৎ করেই নীলা এমন একটি প্রশ্ন করে বসলো। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে বলে চললো,
-জানেন মেঘ, আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে কবিতা লিখি। কবিতার প্রতিটি ছন্দে অনেক আবেগ, ভালোবাসা আর পাওয়া না পাওয়ার গল্প লেখা থাকে। কেউ কবিতার মধ্যে তার নিজের সারাটা জীবন দেখতে পায়, কেউ খুঁজে পায় নতুন জীবনের প্রতিচ্ছবি।
-দেখো নীলা, আমি এসব কবিতা খুব একটা বুঝি না। স্কুল কলেজ পাশ করতে যতটুকু জানার দরকার ছিল এই যা। এর বাহিরে কখনো কবিতার বই খুলেও দেখিনি।
-এই যা , আমি কাকে এতক্ষণ ধরে কবিতার আলাপ করছিলাম। অনেক ভুল হয়ে গেছে, আপনি কিছু মনে করেন নি তো মেঘ?
-না, না। প্রত্যেক মানুষের জীবনে তার পছন্দের বিষয়গুলো আলাদা থাকে। এই ধরো, কেউ গান ভালোবাসে, কেউ প্রকৃতি, কেউ ফুল। কারো আবার ঘুরতে যেতে খুব ভালো লাগে।
-আপনি ঠিক বলেছেন, এই আলাদা গুনগুলোই তো মানুষকে আলাদা একটা পরিচয় তৈরী করে দিয়েছে।
-তুমি ভালো থেকো নীলা। নীল আকাশের মত বিস্তৃত হোক তোমার পথ চলা। অনেক বেশি শুভকামনা রইলো তোমার জন্য। হয়তো আবার দেখা হবে।
মেঘ আর নীলার প্রথম সাক্ষাতে যেন বিচ্ছেদের সুর ঘটে গেলো, মেঘের নীলার মতো চঞ্চল একটা মেয়েকে হয়তো ঠিকমত মনে ধরে নি। মেঘ কি তাহলে আকাশের মত বিশাল বিস্তৃত নীলাকে নয়,সাগরের মত শান্ত, স্তব্ধ কাউকে চায়?
নীলা ভাবছে তার এই বেশী কথা বলার জন্যই মেঘ তাকে পছন্দ করে নি। বাসায় গিয়ে মাকে বললে মা হয়তো খুব বেশি রাগ করবে না । নীলার মা সবসময় তাকে সমর্থন করে । তার ধারণা, নীলা যেমন তেমনি তাকে কেউ গ্রহণ করবে। এতে হাজার ছেলের উপেক্ষা তিনি মেনে নিবেন। কিন্তু নীলার মনে মেঘকে নিয়ে যে আবহ তৈরী ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। তার কবিতার সুরে কেবল বিচ্ছেদ, নাকি অভিমানের সুর গাঁথা।
-এবারও পছন্দ করেনি?
-এটা তুমি কি করে বুঝলে মা? আমি কি তোমাকে একবারও সে কথা বলেছি।
-আমি যে তোর মা, তোর চোখের দিকে তাকালেই আমি সব বুঝতে পারি। যদি পছন্দ করতো তোর চোখের মধ্যে খুশির চমক দেখতে পেতাম।
-মা, আমি আমার এই চঞ্চলতা কখনো পরিহার করবো না। আমি কবিতার মত উদ্দাম বেগে ছুটতে থাকবো।
বেশ কিছু মাস কেটে গেছে,
নীলা আগের মতই আছে, এখনো সে তার নিজের মত করে কবিতা লেখে, মাঝে কিছু অচেনা অপরিচিত ছেলে আসে আর চলে যায়। নীলা বুঝে উঠতে পারে না কেনো তাকে কেউ পছন্দ করে না।
নীলা তার নামের মতই নীলচে আভা যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই, দেখতেও মন্দ নয়, হাসলে গালে ছোট্ট একটা টোল পরে, মায়াবী চেহারা, চোখগুলো টান টানা। পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে, মাকে নিয়েই তার জীবন, বাবা ছোট বেলায় একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে মায়ের কাছেই মানুষ সে। মা আর তার ছোট্ট পৃথিবীটা অন্য সবকিছু থেকে আলাদা। এই চঞ্চলতা, উচ্ছলতা তার জীবনকে একটা নতুন ছন্দে বেঁধে রেখেছে।
-হ্যালো নীলা, বলছো?
জি বলছি, আপনি কে বলছেন?
আমি মেঘ, বেশ কিছু বছর আগে তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো।
ও আচ্ছা, এবার চিনতে পেরেছি।
আমরা কি আর একটিবার দেখা করতে পারি?
নতুন করে আবার দেখা করার কারণটা কি? আমাকে তো আপনার আগেই পছন্দ হয়নি। কিছু বলার থাকলে আপনি ফোনেই বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।
কথাগুলো অনেক জরুরি নীলা, দেখা করেই বলতে হবে। তুমি কি আরেকটি বার আসবে আমার কাছে?
নীলা কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ঠিক আছে, কোথায় যেতে হবে?
আগের জায়গাটিতে এসো নীলা। সঙ্গে তোমার কিছু কবিতার বই নিয়ে এসো।
নীলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ভাবছে, যে মেঘ কবিতা পছন্দ করতো না সে আবার কবিতার বই নিয়ে যাচ্ছে কেন? মানুষ কত অদ্ভুত হয় তাই না!! সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। নীলা তার মাকে বলে, একটা নীল রঙের শাড়ী পড়ে খুব সুন্দর করে সেজে দেখা করতে গেলো।
-আমি জানতাম তুমি নীল রঙের শাড়ী পড়ে আসবে। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে নীলা, তোমার রুপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি সারাবেলা, তুমি কি হবে আমার চলার পথের অনুপ্রেরণা?
নীলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে, এই কি সেই মেঘ যে কিছু বছর আগে তাকে প্রত্যাখান করেছিলো? আজকে এসব কথা কেনো বলছে সে? এটা কি সত্যি নাকি নিছক কোনো ছলনা? নীলা এখন কি বলবে তাকে? তার মা থাকলে একটা সুন্দর সমাধান করে দিতো।
-কি হলো নীলা? উত্তর দিচ্ছো না যে?
-দেখেন মেঘ, আপনি একদিন আমার চঞ্চলতার জন্য আমাকে গ্রহণ করেন নি। আজকে হঠাৎ এত বছর পর এসে সব ঠিক করে নিতে চাইছেন। আমি এসবের কিছুই বুঝে উঠতে পারতেছি না।
-নীলা, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। কত মেয়ে দেখেছি এত বছর ধরে কিন্তু তোমার মতো কাউকে খুঁজে পাইনি।
-আজকে আমাকে আপনার ভালো লাগছে কালকে আবার মনে হবে অন্য কেউ ভালো, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন।
-না, না। আমি আর কখনও তোমাকে হারানোর মত ভুল করবো না।
-আমি আজ আসি মেঘ। আপনি ভালো থাকবেন।
নীলার চলে যাওয়া দেখছে মেঘ, একটিবার গিয়ে কি আটকাবে নীলাকে? না, নীলাদের গতি হয় ঝড়ের মত, তাদেরকে থামানো যায় না। মেঘের আর এই জীবনে নীলাকে পাওয়া হলো না।
-এবারও হলে না?
-না, মা। এবার আমি মানা করে দিয়েছি। একবার প্রত্যাখান পেয়ে এসব বিয়ের প্রতি ইচ্ছে মিটে গেছে।
-অনেক ভালো করেছিস তুই। এখন থেকে নিজের মত বাঁচবি তুই।
মেঘ আর নীলাদের মিল খুব কম হয়, এরা একে অন্যের বিপরীত হয়ে একসাথে চলার কথা ভাবলেও নিয়তি নামক জিনিসটা তাদেরকে এক হতে দেয় না। বারবার বাঁধা আসে, কখনও জয়ী হয় আবার কখনও হেয়ে যায় বাস্তবতার ভীড়ে।