নারীভীতি

মনের মধ্যে যখন কোনো বিষয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় ,তখন ভয়-ভীতির জন্ম নেয়।কিন্তু সেই ভয় বা ভীতি যখন মাত্রাতিরিক্ত কোনো বিশেষ বিষয় বা জিনিসকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় ,তখন তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় “ফোবিয়া” বলে।এই ফোবিয়া বিভিন্ন রকমের হতে পারে।কারও উচ্চতায় ভীতি (হাইপোফোবিয়া) ,কারও আগুন ভীতি ,পানি ভীতি ,এগারোফোবিয়া বা ঘর থেকে বের হওয়ার ভীতি ,আবার কারও অন্ধকার ভীতি ,এরকম নানা ধরণের ফোবিয়া রয়েছে।ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ফোবিয়া খুবই বিরল।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নারী ভীতি বা উইমেনফোবিয়া।
আমার তখন পঞ্চম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে।কিশোরগঞ্জে থাকতাম। কিন্তু এরই মধ্যে আমার বাবা ও মার একই সাথে চাকরিসূত্রে ময়মনসিংহে বদলির নোটিশ আসে।তার আমাদেরকে অবিলম্বে কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহে স্থানান্তরিত হতে হবে।আমার পরীক্ষার ফলাফল যেহেতু ডিসেম্বরের শেষ দিকে হবে ,সেহেতু জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ময়মনসিংহে বাসা বদলের সিদ্ধান্ত হলো।
ডিসেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহে আমাদের বাসার বিপরীত দিকে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে।প্রতিদিন বিকেলে আমাদের বাসার ছোট গলির মধ্যে অভ্যাসবশত কিছুক্ষণ হাটাহাটি করি।সেই সুবাদে ঐ নতুন বাসার পান্নার (আমার সমসাময়িক) সাথে পরিচয় হয়।আলাপ চারিতায় জানা যায়,তার পরিবারে সে ,তার মা- বাবা ও তার বড় ভাই থাকে।আমাদের বিদায়ের বেলা ঘনিয়ে এসেছে আর পান্নারা সবেমাত্র এসেছে।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমার আর পান্নার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়।এরকম এক বিকেলে হাটতে বের হওয়ার কারণে পান্না আমাকে এক প্রকার জোরপূর্বক তাদের বাসায় নিয়ে গেল।পান্না দরজায় কড়া নাড়ল।ভিতর থেকে ছেলে কন্ঠে আওয়াজ আসলো (সম্ভবত পান্নার ভাই) , -কে ?
জবাবে পান্না বললো , আমি ,দরজা খোলো ।”
ভিতর থেকে আওয়াজ এলো , আমি! কে ?
পান্না উত্তর দিলো , আমি ,তোমার বোন
ভাই আশ্বস্ত হয়ে দরজা খুললো।কিন্তু দরজা খুলেই ভো-দৌড় ।পান্নার ভাইয়ের এই কান্ড দেখার পর আর ভিতরে ঢুকলাম না।পরের দিন বিকেলে পান্নাকে তার ভাইয়ের হঠাৎ দৌড়ানোর কারণ জিজ্ঞাস করলাম।
পান্না বললো যে , তার ভাইয়ের নাম হীরা।পান্নার থেকে বছর খানেকের বড়।তার ভাই হীরার বয়স যখন চার বছর তখন নাকি একবার হারিয়ে যায়।প্রায় তিনদিন ধরে হীরা নিঁখোজ।পান্নার মা-বাবা থানায় জিডি করে।তিনদিন পর হীরাকে উদ্ধার করা হয়।কিন্তু হীরার মধ্যে এক অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করা যায়।দেখা যায় ,হীরা মা-বোন ব্যাতীত সমবয়সী নারীদেরকে দেখে ভয় পায়।সামনাসামনি দাড়ানো তো দূরের কথা ,কোনো নারীর সাথে কথা বলতে পর্যন্ত ভয় পায়।অর্থ্যাৎ ,হীরার মধ্যে নারীভীতির জন্ম নেয়।হীরার মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। হীরাকে অনেক সাইকোলোজিস্ট দেখান।কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।

হীরাকে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়।কিন্তু সেখানেও সমস্যা।স্কুলে মেডামদের সাথে হীরা কোনোভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সব মিলিয়ে অবস্থা খুবই জটিল।হীরা যদি বাসা থেকে বেরও হয় ,তবে তার চোখ মাটির নীচে থাকে।

ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখ হীরার জন্মদিন। কাকতালীয়ভাবে একই দিনে আমারও জন্মদিন!আবার বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও সেই দিনই ছিলো।জন্মদিনের কথা গোপন করে বন্ধুদেরকে বাসায় নিমন্ত্রণ করলাম। শেষদিনটি বেশ আনন্দে কাটালাম। পান্নাকেও বাসায় আনলাম।

পান্না জানালো ,কী একটা কারণে পান্নার ভাইয়ের জন্মদিনটা ২৮ তারিখ পালন করবে।ভাই হীরাকে খুশি রাখতেই প্রতিবছর জন্মদিন পালন করা হয়।অবশেষে ২৮ তারিখ এলো।আমরা জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলাম। সন্ধ্যার দিকে দরজায় কড়া।খুলে দেখলাম পান্না।পান্না বললো তার ভাইয়ের জন্মদিনে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালো।এমন সময় নিমন্ত্রণ জানালো যে কী উপহার দিবো ভাবলাম।
ঠিক করলাম, একটা জেলপেন রঙিন রেপিং পেপারের মোড়কে উপহার দিবো।সেখানে লেখা থাকবে –  হীরা ভাইকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ।
উপহার নিয়ে পান্নাদের বাসায় গেলাম। ঘরটা অল্প আয়োজনে সুন্দর করে সাজানো। ছোট কেকের চারপাশে বেলুন।হীরার জন্মদিনে তার দাদা বেড়াতে এসেছেন।হীরা প্রথমে সূচ দিয়ে বেলুন ফাটালো।তারপর কেক কাটলো।তারপর হীরাকে ভদ্রতার খাতিরে (যদিও জানতাম) তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। হীরা নীচুস্বরে জবাব দিলো।হীরার হাতে আমি উপহার তুলে দিলাম। হীরা ছোট করে ধন্যবাদ জানালো।হীরার মা ছেলের নারীভীতি নিয়ে খুবই চিন্তিত। তবুও ছেলের চিকিৎসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।বিদায়ের ক্ষণে সবার সাথে দেখা হলো।বিদায়ের মুহূর্তটাই এমন- ” যেতে নাহি দেব হায় ,তবু যেতে দিতে হয়।”
কিশোরগঞ্জে প্রতিবেশী লিখন আন্টি ,বন্যা আপু ,সারা-বেলা দুই বোনের কথা সব সময় মনে থাকবে।আর হীরা-পান্না দুই ভাই-বোনের কথা তো কখনও ভুলে যাবার নয়।জানি না – পান্নার ভাই হীরার এখন কী অবস্থা —নারীভীতি আছে নাকি কেটেছে ? যাই হোক ,আশা করি সব ভালো ও মঙ্গলময় হবে।

লেখাঃ সাবরিনা তাহসিন

আকুয়া, ময়মনসিংহ। 
Scroll to Top