বাংলাদেশের বিজয় দিবস একদিনে অর্জিত হয়নি। প্রায় নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের বিজয় অর্জিত হয়েছে। বিজয়ের মাসে জন্মগ্রহণ করাটা আমার কাছে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। বিজয় দিবসে কিছু টুকরো টুকরো স্মরণীয় ঘটনা আছে। এর মধ্যে তিনটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরলাম।
বাসা থেকে শোনা যেত- রক্ত লাল, রক্ত লাল
আমার বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। প্রথমদিকে নেত্রকোণা শহরেই আমাদের বাসা ছিল। নেত্রকোণা জেলা স্টেডিয়ামটা আমাদের বাসা থেকে বেশ কাছাকাছি ছিল। বাসা থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে অথাৎ ১৫ ডিসেম্বর রাতে শোনা যেত ৩১ বার তোপোধ্বনি, যার মাধ্যমে মহান বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো।
বিজয় দিবসের দিন ভোর থেকেই দেশাত্ববোধক গানে চারদিক মুখরিত হতো। আর সকাল আটটা থেকে স্টেডিয়ামের শুরু হতো বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজ, দেশাত্ববোধক গানসহ নানা আয়োজন থাকত। বিশেষ করে- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্ত লাল, রক্ত লাল… এই গানটা কিছুক্ষণ পরপর বাজতো। আর সেই গানের তালে তালে কুচকাওয়াজ আর কখনও নাচ পরিবেশন করত বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আমাদের বাসা স্টেডিয়ামের খুব কাছে হওয়ার কারণে, ছাদ থেকেই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখতে পারতাম। এই বিষয়টা বেশ উপভোগ করতাম।
বিজয়ের দিনে কবিতা আবৃত্তি
তখন সম্ভবত আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে (পরীক্ষণ বিদ্যালয় পি.টি.আই, কিশোরগঞ্জ) স্কুলে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমি, কিশোরগঞ্জ কর্তৃক আবৃত্তি-কুইজ-রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হবে এইমর্মে একটি নোটিশ আসে। আবৃত্তির বিষয়বস্তু হিসেবে কবি আহসান হাবীব রচিত-ঘুমের আগে কবিতাটির কথা উল্লেখ করা ছিল। আমি বরাবরই কবিতা আবৃত্তি করার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলাম। তাই আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য নাম জমা দিই।
আহসান হাবীব-এর ঘুমের আগে কবিতাটি বাসায় এসে ভালোভাবে আবৃত্তি করে অনুশীলন করি। ভালোভাবে কোনো কিছু আত্মস্থ করার জন্য বাবা আমাকে একটা ওয়্যাক-ম্যান কিনে দিয়েছিলেন। আমি যতোবার ঘুমের আগে কবিতার-
জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানে না।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানে না।
মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !
আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়।
আবৃত্তি করে অনুশীলন করি, তখন সেটা ওয়্যাকম্যানে রেকর্ড করে ফেলি। আর বার বার সেই রেকর্ড করা আবৃত্তি শুনে চেক করি কোথাও কোনো ভুল হয়েছে কী-না । এভাবে তিন-চারদিন অনুশীলন করার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নির্ধারিত সময়ে আম্মুর সাথে কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে চলে গেলাম। আমার এক সহপাঠিও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিল। আমরা দুইজন নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে আসন গ্রহণ করি। যদিও আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার এই স্টেজে পারফরম্যান্স করেছিলাম, তবুও কেন যেন মনে খুব ভয় হচ্ছিল।
তবে আমার সাথে আম্মু আর আমার সেই সহপাঠি ছিল বলে ভয়টা আস্তে আস্তে কেটে গিয়েছিল। যখন আমার নাম ঘোষণা করা হল তখন প্রথমে নার্ভাস থাকলেও স্টেজে ওঠার পর নার্ভাসনেসটা কেটে গেল, আমি ‘ঘুমের আগে’ কবিতাটি বেশ ভালোভাবে আবৃত্তি করলাম। আবৃত্তি শেষে সকল দর্শক-শ্রোতা করতালির মাধ্যমে আমাকে অভিবাদন জানায়। আমার সেদিন খুব ভালো লেগেছিল।
নিজ চোখে সাভার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ
১৪ই ডিসেম্বও, শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস উপলক্ষ্যে ছুটি ছিল। পরদিন বৃহস্পতিবার থাকায় ভাবলাম একটু ঢাকা থেকে ঘুরে আসা যেতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ তারিখ সকাল সকাল ময়মনসিংহ থেকে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তথন ১২টা বেজে যায়। হালকা কিছু খেয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাসানী নভো থিয়েটারে যাই। আমার খালামণি স্ব-পরিপারে ঢাকায় থাকে বলে তাদেরকেও সেখানে উপস্থিত থাকতে বলেছিলাম। কারণ ভাসানী নভোথিয়েটারের টিকেট সংগ্রহের জন্য অনেক লম্বা লাইন ধরতে হত। ভাসানী নভোথিয়েটারে গিয়ে দেখি খালামণি,খালু আর খালাতো বোন লাইনে দাঁড়িয়ে। তখন দুপুর ২ট বাজে খালামণির হটপটে আনা খিচুড়ি খেয়ে নিলাম; কিন্তু পালাক্রমে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে করতেই বিকেল পাঁচটা বেজে যায়। আর আমাদের ট্রেনের টিকেট কাটা ছিল সন্ধ্যা ৬:০০ টায়। নভোথিয়েটারে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, মহাকাশ সম্পর্কিত ডকুমেন্টারি দেখতে দেখতে প্রায় ছয়টা বেজেই যায়।
তাই, আমাদের আর সেদিন ট্রেনে করে ময়মনসিংহে ফেরা হয় না। খালামণিদের অনুরোধে ১ রাত তাদের বাসায় থেকে পরের দিন বিকেলের ট্রেনে ময়মনসিংহে ফেরার সিদ্ধান্ত হলো। সেদিন রাতে বসুন্ধরা সিটিতে গেলাম, অনেক রাইডে চড়লাম, মজা করলাম।
পরের দিন সকালে ইচ্ছে হলো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখা। আমার খালু গাড়ীর কোম্পানীতে বিজনেস করতেন বলে একটা মাইক্রো ভাড়া করেন। আমরা সকালের নাস্তা করেই সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
সাভারে যাওয়ার সময় চারপাশের নিরিবিলি, ছিমছাম পরিবেশ আমার মনকে বেশ প্রফুল্ল করে তোলে।
অবশেষে ঘন্টা দেড়েক পর জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে পৌঁছালাম। পরের দিন যেহেতু বিজয় দিবস, সেহেতু জাতীয় স্মৃতিসৌধের চারপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছিলো। যাই হোক, কাছ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখে বেশ ভালো লাগলো। খালি পায়ে বেদীতে উঠে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর ফলকগুলো বেশ কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
জানতে পারলাম, জাতীয় স্মৃতিসৌধে যে সাতটি ফলক সেটা মুক্তিযুদ্ধের সাতটা ঘটনার তাৎপর্য বহন করে (৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট, ৫৬ এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ)। সত্যিই সেদিনের দিনটা বেশ ভালোই উপভোগ করেছিলাম।
লেখাঃ সাবরিনা তাহসিন