মেঘবালিকা

কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট। ভুলটা শাহেদেরই ছিল। বেপরোয়া গতিরোধ! কী সাংঘাতিক! সবাই আহত। অগত্যা পাশের সদর হাসপাতালে ডাক্তারের দরবারে হানা দেওয়া। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বের হওয়ার পথে দেখি একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। রোগীর অবস্থা সিরিয়াস। এখানকার ডাক্তার চট্টগ্রাম মেডিকেলে রেফার করেছেন।

গাড়িতে উঠবো এমন সময় সাফওয়ান বলে উঠলো- মাহীন, মেয়েটা বৃষ্টি না? চেহারাটা সেরকম চেনা চেনা লাগছে। একটু দেখে আসবি?

বৃষ্টি এখানে! অ্যাম্বুলেন্সের আশেপাশে সাত কি আটজনের মত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। সাফওয়ানের কথায় গেলাম দেখতে।

হ্যা, সাফওয়ান চিনতে ভুল করেনি। সে বৃষ্টি কিন্তু ওর মাথা রক্তাক্ত কেন!

দাঁড়িয়ে থাকা পাশের কজন থেকে জানতে পারলাম। মেয়েটি নাকি নিজের মাথা নিজেই আঘাত করে রক্তাক্ত করেছে। আবার কেউ বলছে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। আবার কেউ বলছে স্বামীর সাথে রাগ করে এমন করেছে। এ জনাকয়েক মানুষের একেকজনের একেক বয়ান জানিয়ে দিচ্ছে ভেতরের ঘটনা অন্যকিছু। কে সত্য কে মিথ্যা সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

ডিউটিরত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলাম। জানতে পারলাম মাথার দুপাশেই ইনজুরি। রক্ত দুই ব্যাগ দেয়া হয়েছে। আরও লাগবে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে রেফার করেছেন। আপাতত এর বেশি কিছু জানিয়ে তিনি মুখ খুলছেন না।

দূর থেকে বৃষ্টিকে দেখলাম। আলতো রংয়ে মাখা মুখটা রক্ত লালে সেজে আছে।

কিছুক্ষণ পর জাওয়াদ তাড়া দিলো, পুরোনো অতীত নিয়ে ভাবিস্ না। যে নেই, তা নাই হয়েই থাকুক। এখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আমাদের ফ্লাইট মিস হবে। সো হারি আপ!

দেরি না করে আমার পাঁচ বন্ধু রওনা দিলাম। কেন জানি না বুকের বাঁ পাশটায় ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কী যেন যন্ত্রণা! বৃষ্টির সাথে এভাবে দেখা না হলেও পারতো।

আমাদের বাড়ির পাশের পাড়ার মেয়ে বৃষ্টি। এক বিয়ের আসরে প্রথম তাকে দেখেছিলাম। তখন ও সবে ক্লাস নাইন কী টেনে পড়ে। প্রথম দেখাতেই ঘোর লাগানো ভালোলাগা। ছবি আঁকায় বেশ ভালো হাত ওর। পুরষ্কারও জিতেছে অনেক। এলাকায় আঁকিয়ে হিসেবে দারুন সুনাম তার। ওর বাবা তো কথায় কথায় মেয়ের আঁকাআঁকি প্রসঙ্গ তুলে আনতেন। আমার বাবার পরিচিত মানুষ বৃষ্টির বাবা। কথার ছলে আমার বাবা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। বৃষ্টির বাবা হেসে উড়িয়ে দিলেন, মেয়ে তো এখনও ছোট। এখন কী বিয়ে?

কথা পাকা করে রাখলে মন্দ না। বিয়ে না হয় বছর দশেক পরে হোক। ছেলে সবে পড়তে যাচ্ছে আমেরিকায়।

হ্যাঁ, বৃষ্টির বিয়ে হয়েছে। তবে বছর দশেক পরে নয়, পাঁচ বছরের মাথায়। আমি তখন ফাইনাল সেমিস্টারে। বাড়ি ফিরে জানতে পারি বৃষ্টির মা ঘোর বিরোধ করেছেন প্রবাসে পড়ুয়া ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। তার বক্তব্য-

বিদেশে বসবাসরত ছেলেরা মোটেও ভালো নয়। এরা একটাকে রেখে আরেকটাকে নিয়ে ঘুরে। এদের চরিত্রের দোষ আছে। দেশে থাকে এমন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবো। দেশের ছেলেরা এমন নয়। অন্তত চোখে চোখে রাখা যাবে।

ভালোই হলো যাচাই-বাছাই না করে যে মহিলা এমন কথা বলতে পারেন সে আর যাই হোক শ্বাশুড়ি হবার যোগ্যতা রাখেন না।

বাবার কাছ থেকে জানতে পারলাম বিয়েতে বৃষ্টির বাবার মত নেই। বৃষ্টির বিয়েটা তার মায়ের পছন্দেই হচ্ছে। অনেকটা জোর করেই।

আমার বাবা মা বৃষ্টিকে নিয়ে এত বেশি আশা করে রেখেছিলেন বুঝতে পারিনি। যতদিন দেশে ছিলাম বাবা বৃষ্টির কথা বলতো-  এ রকম মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কোনো মারপ্যাঁচ নেই, সহজ সরল, বয়ফ্রেন্ডের চক্করও নেই, আড্ডা মজলিসে আড্ডালাপে নেই। বৃষ্টিকে হারিয়ে তাদের হা হুতাশের কমতি নেই।

জানি না নিজের মনালাপে ওকে কীভাবে যেন ভালোবেসে ফেললাম। আমি নিজেই বৃষ্টির বাবার কাছে যাব বলে মন স্থির করলাম।

বিয়ের দুইদিন আগে তার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বাবা-মায়ের কথা ভাবছিলাম। বৃষ্টির মায়ের অপমান আর দম্ভের কাছে হেরে গেলাম। বৃষ্টির বাবার আচরণে বুঝলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েটা দিলেও বিয়েটা জরুরি ছিল।

সেদিন বৃষ্টিকে দূর থেকে দেখেছিলাম। ছাদে দাঁড়িয়ে এলোচুলে হেসে হেসে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। ভালো থাকুক ভালোবাসা, ভালো থাকুক সেই মায়াবী হাসি। সে হয়তো কোনোদিনও জানতে পারবে না তার জন্য মাহীন নামে কোনো এক ছেলে মনের কল্পনায় তাকে রাণী সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছিল।

আজ বিশটা বছর পর এভাবে যে দেখা হবে বুঝতে পারিনি। বিশ বছর! অনেক দীর্ঘ সময়! আমার বাবা গত হয়েছেন। মাও শ্যাযাশায়ী। আমার পরিবারের সবাই এখন আমেরিকায় থাকেন। আমার মা দেশের আত্মীয়দের শেষ দেখা দেখবেন বলে দেশে এসেছেন। ক্যান্সারের দাবানল তাকে অল্প অল্প করে শেষ করে দিচ্ছে।

কক্সবাজার থেকে ফেরার পর নানার বাড়ি পৌঁছে যা দেখলাম তা দেখার জন্য  আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মা দিব্যি হেসে হেসে চিৎকার করে কথা বলছেন। আমাকে দেখে দৌঁড়ে এসে বললেন, টিকিট ২/৩ দিন পেছানো যায় না?

আমি বললাম, কেন? অসম্ভব আমার আগামী পরশু থেকে টানা চারদিন জরুরি মিটিং। না গেলে অফিসের ক্ষতি হবে। প্রয়োজনে পরে আবার আসব।

ঘণ্টাখানিক পর এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এর মধ্যে মা কোথায় যেন ঘুরে আসলেন।

ফ্লাইটে ওঠার পর মা আমার হাতে হাত রেখে বললেন, দম্ভ মানুষকে কোথায় থেকে কোথায় এনে দেয়। আমি এখানে আসার আগে বৃষ্টিকে দেখতে গিয়েছিলাম। মাহফুজকে সাথে নিয়ে। বৃষ্টির স্বামীর পরকীয়া এখন সবার মুখে মুখে। বিয়ের আগের হিসেবটা জানা নেই তবে বিয়ের পর এই নিয়ে চার নম্বরে পরকীয়ার সিরিয়ালে ঠেকেছে।

-মা, কাজটা কি ঠিক করেছো? আমাকে না জানিয়ে।  এভাবে যাওয়া তোমার ঠিক হয়নি। ওই বদ মহিলা তোমায় কি কিছু বলেনি?

-কীভাবে বলবে? আমি গিয়েছি সেটা জানলেই তো বলবে।

-মানে? তুমি লুকিয়ে দেখা করেছো?

-তোর পুরোনো ডায়রি থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে ফেলেছি। আমি সব করে এসেছি। পুরোনো হিসেব বাদ। নতুন করে গল্পটা এখানেই শুরু হোক। বলেই আমার মা আমার কাঁধে মাথা রেখে এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন যেন এতদিন এটার অপেক্ষায় ছিলেন।

হাসপাতালে বৃষ্টির জ্ঞান ফিরলে টেবিলে রাখা কাঠগোলাপের গুচ্ছ দেখতে পায়। বৃষ্টির মা পাশেই ছিল। তিনি জানেন না- কে এই গোলাপগুচ্ছ রেখে গেছেন। কিছুক্ষণ পর এক নার্স এসে একটা চিঠি বৃষ্টির মায়ের অগোচরে বৃষ্টিকে দিয়ে গেল। বৃষ্টি চিঠিটা খুলতেই দেখতে পেল। সেটা অনেক আগে লেখা পুরনো এক চিঠি।

মেঘবালিকা,

আমি তোমার নাম রেখেছি মেঘবালিকা। আমার স্বপ্নের অপ্সরা। আমায় তুমি চিনবে না। চেনার কথাও না। ধরে নাও তোমার অদেখা, তোমার জন্য প্রতীক্ষিত এক রাজকুমার। তুমি তোমার মত করে আমার একটা নাম রেখে দিও। তোমার ভিলেন মায়ের সামনে যাওয়ার সাহস আমার নেই। তোমার বাবার মত অত বড় রাজপ্রাসাদ আমার নেই তবে আমার নিজের সবুজরাজ্য আছে। সেখানে অনেক ফুলের বাগান আছে, আছে পাখির গান, আছে ঝরণার সুর। আমার ইচ্ছে সেই সবুজরাজ্যে তোমাকে নিয়ে একটা চড়ুইভাতি করব। তারপর না হয় তুমি ডিসিশান নেবে এখানে থাকবে কি থাকবে না। তোমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে লকডাউনে পড়ে গেলে আমি কিন্তু তোমায় ছাড়ছি না। কারণ, শুনেছি অচিন পাখি একবার উড়ে গেলে সে আর নতুন নীড়ে ফিরে আসে না। আসবে তো? সাহিত্য অতটা মাথায় খেলে না যতটা হৃদয়ে খেলে। কলমের কালিটাও অতটা গাঢ় নয় যতটা আমার মনে তোমার চোখের রংটা খেলে। আসবে তো কাঠগোলাপের ভালোবাসায়?

বৃষ্টি চিঠিটা পড়ে।  চিঠির উল্টো পিঠে দুটো ফোন নম্বর। চিঠিটা তার মাকে দেখিয়ে সে বলে, তুমি কি কিছু লুকিয়েছিলে? আমি জানি না, এমন কিছু?

প্লেন চলছে আকাশের সাদা মেঘ ভেদ করে। মাহীনের মনে চলছে আস্ফালন, মেঘবালিকা তুমি আমার, আমারই ছিলে, তুমি আমারই হবার অপেক্ষায়। আমি আবার ফিরে আসব। আমি চাই একবার, শুধু একবার একটা নতুন নাম দিয়ে  আমার ছবিটা তুমি আঁকো। আমি আসব এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায়। এই মাহীন আমৃত্যু তোমার নিশ্বাসের বিশ্বাস হয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এখন শুধু অপেক্ষা।

 

 

Scroll to Top