রাহেলা শরীফের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী; কিন্তু হলে কি হবে, শরীফ মানুষটা নামের মতই শরীফ- অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক, বিবেকবান, দায়িত্ববান ইত্যাদি। রাহেলাকে এতটুকু অবহেলা বা অযত্ন করে না, হ্নদয়ের গভীরে প্রথম স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থাকলেও সেটা সে কখনো প্রকাশ করেনি, বরং রাহেলাই যদি কোনো সময় কথা প্রসঙ্গে স্বামীর প্রথম দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছে, কৌশলে এড়িয়ে গেছে শরীফ।
রাহেলা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বাবা স্কুলের শিক্ষক, মা সুগৃহিনী, চার ভাই বোনের মধ্যে রাহেলা সবার বড়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরই শরীফের সাথে বিয়ে হয়, বাকী তিন ভাই বোন স্কুলে পড়ছে।
শরীফ সরকারি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, বাড়ি গাড়ি সবই আছে- প্রচুর বিত্তশালী,
ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মাধ্যমে রাহেলা পরিবারের সাথে যোগাযোগ এবং বিয়ে। শরীফ বিপত্নীক বলে বাবা কোনো আপত্তি করেননি, কারণ শরীফকে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। এমন সুপাত্র পেয়ে তিনি দ্বিধা না করে মেয়ের বিয়ে দেন, শর্ত শুধু একটাই ছিলো যে মেয়ে যতদুর পড়তে চায়, তাকে পড়াতে হবে। শরীফের কোনো আপত্তি ছিলো না, সে সানন্দেই রাজী ছিলো কিন্তু রাহেলাই আর পড়তে চায়নি। শিক্ষক পিতার অসচ্ছল সংসারে তার জীবনের সাধ শখ তেমন মেটেনি তাছাড়া নীতিবান আদর্শ পিতার নানা রকম বিধি নিষেধ মানতে মানতে সে ত্যক্ত হয়ে উঠেছিলো, বাপের অবাধ্য হবার সাহস তাদের কারোই ছিলো না তাই বিয়েটা হতে সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
তারপর ভালো মানুষ স্বামীর উদার মন মানসিকতার পরিচয় পেয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায়।
ইচ্ছে মত শখ সাধ মেটাতে দেরী করেনি। বাপের নীতি, আর্দশ, শিক্ষা ভুলে মনের আনন্দে সে নতুন জীবন উপভোগ করতে লাগলো।
শরীফের বয়স স্ত্রীর চেয়ে কিছু বেশীই হবে তাই সে রাহেলাকে খানিকটা প্রশ্রয়ই দেয়, কোনো কাজেই বাঁধা দেয়নি, ভাবে ছেলে মানুষ। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সব ঠিকই ছিলো কিন্তু অশান্তি শুরু হলো অন্য এক ব্যাপারে।
শরীফের প্রথম পক্ষের একটি মেয়ে ছিল আলো, মেয়ের তিন বছর বয়সের সময়ই ওর মা মারা যায়, এটাও রাহেলারা জানতো, শরীফ কিছুই গোপন করেনি, মা মরা মেয়েকে শরীফের ফুপু নিজের কাছেই রেখেছিলেন, বতর্মানে আলোর বয়স সাত বছর।
বিয়ের পরপরই শরীফ মেয়েকে নিয়ে আসেনি, রাহেলাকে সময় দিয়েছে সব কিছুই মানিয়ে নেবার, বুঝতে চেয়েছে সতীনের মেয়েকে আপন করে নিতে পারবে কিনা, যদিও এই বিয়েটা সে করেছে বিশেষ করে মেয়ের জন্যেই, ফুপুর কাছে আলো যথেষ্ট ভালোই ছিলো তথাপি পিতৃস্নেহ তাকে বাঁধা দিয়েছে মেয়েকে দূরে রাখতে, তাই দ্বিধা কাটিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, এই ভেবে যে নতুন মা ওর মেয়েকে আপন সন্তান স্নেহে লালন – পালন করবে এবং মেয়েটাও সর্বদা বাবার চোখের সামনেই থাকবে।
রাহেলার সাথে খোলাখুলি আলাপ করে বিয়ের প্রায় দুই বছর পর সে আলোকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
রাহেলা খুব ভালোই জানে যে আলো ওর বাপের চোখের মণি, খুবই ভালোবাসে মেয়েকে, তাই মনে যাই থাকুক, বাইরে সেটা প্রকাশ করলো না, বরং আগ্রহ দেখিয়ে স্বামীকে উৎসাহ দিলো, শরীফের যেটুকু দ্বিধা ছিলো, স্ত্রীর ব্যবহারে খুশী হলো।
আলো, খুবই লক্ষ্মী একটি মেয়ে, দেখতেও চমৎকার; দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। সে প্রথমে বাবার সাথে আসতে চায়নি কারণ ফুপুর আদর স্নেহ ওর মায়ের অভাব পূরণ করেছে। ফুপুকেই মা বলে জানে, ভালোবাসে, ডাকেও মা বলে, অগত্যা ফুপুই অনেক বুঝিয়ে আলোকে রাজী করান।
আলো প্রথম প্রথম আড়ষ্ঠ হয়ে থাকতো, রাহেলার কাছে যেতে চাইতো না, শরীফ অনেক আদর করে মেয়েকে বুঝাতো। যাও মা, ও তোমার মা, তোমাকে কত আদর করবে, তুমি যা যা পছন্দ করো সব করবে, লক্ষ্মী মা আমার, যাও মা ডাকছে।
অন্তরের জ্বালা চেপে রাহেলাও বলতো। এসো মাম্মি, তোমার সাথে ভাব করি, আগে বলোতো তুমি কি কি খেতে পছন্দ করো?
এভাবেই রাহেলা ধীরে ধীরে আলোকে বশ করে ফেললো। এখন তো আলো মাম্মি বলতে অজ্ঞান।
শরীফ খুব খুশী হলো। যাক বিমাতা সুলভ আচরণের বদলে রাহেলা আপন সন্তান স্নেহেই আলোকে বুকে টেনে নিয়েছে;
রমণীর মনের ভাব স্বয়ং দেবতারও অজানা, সেখানে বেচারা শরীফ কি করে স্ত্রীর মন বুঝবে?
বুঝলে এতটা নিশ্চিন্ত হোতো না।
রাহেলা কদিনের মধ্যেই কৃত্রিম আদর সোহাগ দিয়ে আলোকে একদম বশ করে ফেললো। নিশ্চিন্ত মনে শরীফও ব্যস্ত হয়ে গেলো অফিসের কাজে।
আলোর স্কুল প্রভাতী শাখায়, সাতটার সময় তাকে রাহেলা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় এসে স্বামীকে নাস্তা খাইয়ে বিদায় করে সংসারের যা কাজকর্ম বুয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে আলোর স্কুলে চলে যায়। শরীফ অফিসে পৌঁছেই গাড়ি পাঠিয়ে দেয়, আবার সেই সন্ধ্যায় দরকার হয় গাড়ির, কাজেই সারাদিনই রাহেলা গাড়ি নিজের কাছেই রাখতে পারে।
এই কদিনেই সে বুঝে নিয়েছে যে আলো বেড়াতে খুব পছন্দ করে। তাই স্কুল ছুটির পর ওরা দুজন কখনো শপিং করে, আইসক্রিমের পার্লারে যেয়ে সুস্বাদু আইসক্রিম খায়- নয়তো এমনি ঘুরে বেড়িয়ে তবেই বাসায় ফেরে।
এখন শরীফের ফুপু অনেক বিবেচনা করেই আলোর কাছে থেকে দুরেই থাকেন, যতই মায়া মমতা হোক, হাজার হলেও আলো তাঁর নিজের সন্তান নয়, রাহেলাকে যাতে মা হিসেবে মেনে নিয়ে খুশী থাকে, সেই আন্তরিক চাওয়াই ফুপুর, এমনি মাঝে মধ্যে আলোকে দেখতে আসেন, অতটুকু বাচ্চাকে মাতৃ স্নেহে লালন পালন করেছেন, এই মায়ার বন্ধন কি আর সহজে ছিন্ন হয়?
ফুপু শুধু বিশেষ কিছু ব্যাপার রাহেলাকে জানিয়েছেন- আলোর ঠান্ডা লাগার ধাত, একটুতেই সর্দি কাশি হয়- তাই ওর ঠান্ডা কিছু খাওয়া একদম বারণ, এবং টক, ফুচকা ইত্যাদি বাইরের এসব খাবার ওর সহ্য হয় না।
রাহেলা চুপচাপ শুনেছে এবং তখনই ঠিক করে ফেলেছে যে সতীন কাঁটা কিভাবে সবার অজান্তে ধীরে ধীরে উপড়ে ফেলবে। যেভাবে সে কাজ হাসিল করবে তাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
আলোর আবার এসব নিষিদ্ধ খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেশি, ফুপু মা ওকে এগুলো একদম খেতে দিতেন না কিন্তু এই মা যখন ওর পছন্দের জিনিসই খাওয়াতে লাগলো তখন সে একদম আনন্দে আত্মহারা, নতুন মায়ের দারুণ ভক্ত হয়ে গেলো। রাহেলা খুব সুচতুর ভাবে তার কাজ শুরু করে দিলো, আলোকে অনেক আদর করে বললো- মাম্মি, তুমি যে এসব খেতে চাও, এগুলো তো খাওয়া তোমার মানা।
-না, না মাম্মি, আমার ফুচকা, আইসক্রিম, কোক খেতে খুব ভালো লাগে, ফুপু মা আমাকে দিতেন না
-কিন্তু এসব খেলে যে তোমার শরীর খারাপ হবে
-আমার কিচ্ছু হবে না
-তোমার বাবা জানতে পারলে কিন্তু আমাকে বকবেন,
-তুমি ভেবো না মাম্মি , আমি বাবাকে বলবো না
-মনে থাকবে তো? ফুপ মাকেও কিন্তু বলবে না
-কাউকেই বলবো না মাম্মি;
তাড়াহুড়ো করলো না রাহেলা, রোজ নয় মাঝে মাঝেই এই নিষিদ্ধ খাবার মেয়েকে খাওয়াতে লাগলো।
বেশী খেলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই ধীরে এগোতে লাগলো রাহেলা। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না, আলোর শরীর খারাপ হয়ে গেল, ঠান্ডা তো লাগলোই, সেই সাথে বমিও হলো।
শরীফ মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করলো কিন্তু মনে খটকা লাগলো। তখনই কিছু না বলে পরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো। আলোর ঠান্ডা লাগলো কীভাবে? কি খেয়েছিলো, বমিই বা হলো কেন?
আকাশ থেকে পড়া মুখ করে রাহেলা বললো-
-সে কি, ওর শরীর কেন খারাপ হলো আমি জানবো কীভাবে? দেখোই তো কত খেয়াল রাখি মেয়ের, ক্ষতিকর কিছু তো খাওয়াই না।
কন্ঠস্বর করুণ করে বললো রাহেলা, বিব্রত শরীফ হেসেই বললো-না, না, তুমি ওর যথেষ্ট যত্ন করো, বড় নাজুক শরীর আলোর, সহজে কিছু সহ্য করতে পারে না, তুমি কিছু মনে কোরো না, আমি তো সময়ই পাই না, সব তো তুমিই দেখাশোনা করো।
প্রসঙ্গ ওখানেই শেষ হয়ে গেলো কিন্তু সাবধান হয়ে গেলো রাহেলা। কত তাড়াতাড়ি এই আপদ বিদায় করা যায় তারই ফন্দি খুঁজতে লাগলো।
মন্দ মানুষের কুবুদ্ধির অভাব হয় না; হঠাৎই রাহেলার অনেক আগের একটা কথা মনে পড়ে গেলো। আনারস খেতে ও খুব পছন্দ করতো, একদিন দুধ খেয়েই আনারস খেতে যেতেই মা ওর হাত থেকে ফলটা কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন- খবরদার ভুলেও এই কাজ কখনো করবি না, দুধ আর আনারস একসঙ্গে খেলে বিষের কাজ করে, পেটে সয় না, বিষাক্ত হয়ে ফুড পয়জন হয় যার পরিণতি মৃত্যু।
যেমন ভাবা তেমন কাজ, আলোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়িটা পার্ক করতে বলে হাঁটতে হাঁটতে আনারস কোথাও পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলো, কিছু দূর যেতেই এক ফলের দোকানে পেয়েও গেলো- পিছনে তাকিয়ে দেখলো গাড়িটা দেখা যায় কিনা কারণ ড্রাইভার যদি ওকে আনারস কিনতে দেখে তাহলে সাক্ষী থেকে যাবে, না দেখা যাচ্ছে না, ছোট একটা আনারস কিনে দোকানিকে দিয়েই কাটিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে পলিথিনে মুড়ে ব্যাগে রেখে স্কুলে চলে এলো।
এখন রাহেলা তো সত্যিই জানে না যে এই জিনিস বিষের কাজ করে কিনা, তথাপি মায়ের কথায় আস্থা রেখে আলোকে আনারস পুরোটা খাইয়ে, দুধও খাওয়ালো। বুয়াও টের পেলো না, সে বাথরুমে কাপড় ধুচ্ছে, ব্যস কাজ হাসিল, কোনো সাক্ষী প্রমাণও নেই, এখন শুধু অপেক্ষা।
অধীর আগ্রহ নিয়ে রাহেলা বসে রইলো। আলো আপনমনে খেলা করতে লাগলো। অস্থির হয়ে রাহেলা ভাবলো নাঃ এতে বোধহয় কাজ হবে না, কি করবে ভাবছে, এমন সময় আলো তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠলো- খেলনা ফেলে দিয়ে দুইহাতে পেট চেপে ধরে আর্তস্বরে বললো- মাম্মি, মাম্মি, আমার পেট খুব ব্যথা করছে; উহঃ আহঃ!
রাহেলার হ্নদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো, খুশীতে হাততালি দিয়ে বললো- হয়েছে, হয়েছে, আমি সফল, অবশেষে এই আপদকে শেষ করতে পেরেছি, যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে আলোর মুখ, ঘামে ভেজা মুখ নিয়ে সমানে চিৎকার করতে লাগলো, রাহেলা নির্বিকারভাবে বসে দেখতে লাগলো বাচ্চার কষ্ট, বুয়াও চিৎকার শুনতে পেলো না। বেশ অনেকক্ষণ পরে উঠে আলোর দেহে এক ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো- মর মর, আমার হাড় জুড়োয়, আপদ একটা।
তারপর, খবর পেয়ে শরীফ এলো, ফুপু এলেন, ডাক্তারের চেষ্টা ব্যর্থ করে বিকেলের মধ্যেই আলো মারা গেলো।
মারাত্মক ফুড পয়জনে নিষ্পাপ একটা প্রাণ শেষ হয়ে গেলো,
পাথর শরীফ কিচ্ছু বলতে পারলো না, মেয়েকে কবর দিয়ে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, ক্রন্দনরতা রাহেলাকে দেখে, ফুপু কঠোরভাবে বলে গেলেন, সৎ মা কখনো আপন মা হতে পারে না, এই ডাইনীই আলোকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
ডাক্তার বলেছিলেন বাচ্চা বিষাক্ত কিছু খেয়েছিল, বুয়াও কম অবাক হয়নি, সকলের প্রশ্নের জবাবে বললো- যে আলো স্কুল থেকে এসে শুধু নুডুলস খেয়েছে, আর কিছু খেতে সে দেখেনি।
ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি শরীফ, যে চলে গেছে তাকে আর কষ্ট দিয়ে কি হবে, কাকে সন্দেহ করবে? সুতরাং কোনো তদন্ত হলো না। রাহেলা মেয়ের শোকে প্রায় অসুস্থই হয়ে পড়েছে, সেটা দেখেও শরীফ বুঝলো স্ত্রী তার নির্দোষ, মুখ বুজে বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলো সে।
দয়া মায়া স্নেহ প্রেম কৃতজ্ঞতা- মানবমনেরই বৃত্তি এগুলো এবং মানবদেহের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এ দেহ ত্যাগ করে যারা চলে গেল তাদের আবার ও বৃত্তি গুলো আসবে কোথা থেকে?
কারণ জীবনের সুখ দুঃখের সঙ্গে ওগুলোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, ধর্মগ্রন্থ পড়ে জানা যায়। সেখানে সুখ থাকলেও দুখ নেই আর দেহ না থাকলে সুখদুখ বা থাকবে কেন, কাজেই মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটা তর্কসাপেক্ষ।
কদিন পর হঠাৎই একদিন রাহেলা রাতে বাথরুমে যেয়ে চিৎকার করে উঠলো। শরীফ দৌঁড়ে যেয়ে দেখে রাহেলা আতঙ্কিত মুখে বিষ্ফারিত চোখে বাথরুমের জানালার দিকে তাকিয়ে কাঁপছে। একটু সুস্থির হতে জানা গেলো সে নাকি আলোকে দেখেছে। সেই শুরু- রাহেলা প্রায়ই আলোকে দেখতে লাগলো। কেউ কেউ বলাবলি করলো, মেয়েটাকে সত্যিই সে ভালোবাসতো তাই ভুলতে পারছে না, নইলে মৃতকে আজ পযর্ন্ত কেউ দেখেছে?
শরীফ কোনো মন্তব্য করে না, কেবলই ওর মনে হয় কিছু একটা ব্যাপার মিলছে না, ফাঁক থেকে যাচ্ছে, কি যেন মনে পড়েও পড়ছে না।
একদিন অফিসে কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে হঠাৎ মনে হলো। আলো তার কাছে আসার কদিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো এবং প্রায়ই অসুস্থ থাকতো, তবে কি রাহেলাই ওকে কিছু খাওয়াতো? কিন্তু তা কি করে হয়- আলোকে সেও তো কম ভালোবাসতো না।
ইদানীং শরীফ খেয়াল করেছে রাহেলা ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। দুদিন দেখে ওকে প্রশ্ন করলো-
-কি হয়েছে রাহেলা, হাতে কি হলো তোমার?
-ওগো দেখতো শুকে, আমার হাতে আনারসের গন্ধ কেন? সেই কবে আলোকে ওটা খাইয়েছিলাম এখনো গন্ধ থাকবে?
বলতে বলতেই আচমকা থেমে গেলো রাহেলা, শরীফ অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো। কি শুনেছে বুঝতে পারলো না।
শরীফের মনে সন্দেহের বীজ গেঁথে গেলো, এখনো পুরো ব্যাপার অস্পষ্ট কিন্তু বুঝতে পারলো রাহেলাই হয়তো কোনো অঘটন ঘটিয়েছে কিন্তু
প্রমাণ কোথায়?
শরীফ পরে সেদিনই স্ত্রীকে প্রশ্ন করলো-
-আলোকে আনারস কবে খাইয়েছিলে?
-সেই, যেদিন দুধ খেয়ে ব্যথায় ছটফট করছিলো, তার কিছু আগেই তো আনারস খাওয়ালাম।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, মুখ ফসকে কথাটা বলেই রাহেলা আড়ষ্ঠ হয়ে গেলো, আর কোনো কথা বলতে পারলো না,
বিস্মিত, স্তম্ভিত শরীফের মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এলো, রাহু !
দুধ ও আনারস একসঙ্গে খেলে কি হতে পারে তারও এই তথ্যটা জানা ছিল।
ডাক্তারের কাছে যেয়ে নিঃসন্দেহ হলো শরীফ; এই দুটো জিনিস একইসঙ্গে খেলে শরীরে বিষের ক্রিয়া করে- না, কাউকেই কিছু জানালো না, অসহনীয় কষ্ট বুকে চেপে ওর জীবনের শনি, রাহুকে মেনে নিয়ে নীরব হয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম রোবটের মত করতে লাগলো, কারণ রাহেলা গর্ভবতী এবং মানসিক বির্পযয় দেখা দিয়েছে।
রাহেলা যথাসময়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো- হাতে কেবল আনারসের গন্ধ পাওয়া এবং আলোর আত্মাকে দেখা ছাড়া আর কোনো পাগলামী ওর ছিল না।
সদ্যোজাত শিশুকে বুকে নিয়ে আদর করে মুখে চুমু দিয়েই রাহেলা স্থির হয়ে গেলো, কাছে দাঁড়ানো শরীফের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ স্বরে বললো রাহেলা- ওর মুখে।
আর কিছুই বলতে পারলো না, কিছু না বুঝে সন্তানের দিকে তাকিয়ে শরীফের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, মনে মনে বললো- আলো আমার আলো, তুই ফিরে এসেছিস মা?
হাত বাড়িয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নত হয়ে চুমু দিতে যেয়েই দারুণ চমকে উঠলো শরীফ।
শিশুর মুখ থেকে স্পষ্ট, আনারসের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে।
লেখাঃ নাজনীন রহমান