আজ অনেক অনেকদিন পর এই ক্লান্ত মন কল্পনার ডানায় ভর করে আলোর গতিতে সেই মোহনীয় বিকেলে এক জাদুকরের স্মৃতিতে ফিরে গেছে ক্ষনিকের জন্য।
সে প্রায় বছর পনেরো আগের কথা। তখন পড়ন্ত বিকেলে শহরের ঘিঞ্জি গলি আর দালানকোঠার মাঝে চকবাজার বিএড কলেজের খোলা মাঠটা ছিল আমাদের জন্য স্বস্তিতে শ্বাস নেয়ার একটুকরো স্বর্গদ্যোন। দুপুর গড়িয়ে আসার আগে থেকেই মাঠে যাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস চলতো ছোট্ট মনের ভেতর। কখন মাঠের সবুজ ঘাসের নরম বিছানায় গঙ্গাফড়িংয়ের মত তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে পারব! মনে হতো দুপুরের প্রতিটি মিনিট যেন প্রতিটি শতাব্দী, ফুরোতেই চাইতো না।
জানালার কাছে বিকেল উঁকি দিতে না দিতেই একছুটে সূতোকাটা ঘুড়ির মতো বেরিয়ে পড়তাম সাইকেল নিয়ে। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘণ্টিটা অকারণে বাজাতে বাজাতে বিদ্যুৎগতিতে পরমাণুতে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন যেমন অবিরাম ঘুরতে থাকে তেমনি গোলমাঠটার চারধারে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলতাম। ইচ্ছে হতো এ ছুটে চলা পরম গতি লাভ করুক, অনন্তকাল ধরে চলুক।
বিকেলে শিশু-কিশোর সব বয়েসের মানুষের যেন চাঁদের হাট বসতো মাঠে। বড়রা মাঠের একধারে বসে গল্প জুড়ে দিত। আর আমরা!আমাদের বাঁধভাঙা উল্লাস আর শৃঙ্খল ছেঁড়ে বেরিয়ে আসার অনুভূতি ছিল অন্যরকম।শুধু চাইতাম ঘড়ির কাঁটা ওখানেই থেমে যাক। মহাবিশ্বের অমোঘ নিয়ম ভেঙে সূর্যটা আর অস্ত না যাক। কি আর হবে একটা নিয়ম ভাঙলে। আমরা তো রোজই কত নিয়ম ভেঙে ফেলি কোন বিজ্ঞাপন ছাড়াই।
তখন বড়রা সাবধান বাণী দিতেন। বলতেন, খুকি, এত্তো জোরে দৌড়াসনা, পড়লে হাড়গোড় ভেঙে যাবে।খুকি, এই বুঝি সন্ধ্যে নেমে এলো শিগগির বাড়ি চল। কে শোনে কার কথা। সদ্যকৈশোরের চঞ্চল মন স্নিগ্ধ বায়ুতে ঘাসের ডগার মত দোল খেতে খেতে দাপিয়ে বেড়াত সারা মাঠে।
তখন প্রায়ই এক জাদুকর আবির্ভাব হতেন মাঠে। মাঠের একপাশে ছোটবড় সকল ছেলেমেয়েকে একপাশে জড়ো করে বসাতেন। তার মায়াবলে দুরন্ত ঝর্ণার মতো মনও কেমন যেন শান্ত নদী হয়ে যেত। জাদুকর যেন তার অদৃশ্য জাদুতে সময়টা থামিয়ে দিতেন ওখানেই। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথা শুনতাম বসে। মাঠের চারধারের রঙীন ফুলের গাছগুলোও যেন তার কথা শুনত খুব মন দিয়ে। আর মাঝে মাঝে বাতাসে দোল খেয়ে মাথা দুলিয়ে হ্যা সূচক বার্তা দিতো। টকটকে লাল আভায় গাঢ় হয়ে সূর্য তখন অস্তমিত হওয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়েও যেন জাদুকরের কথার জাদুতে ক্ষনিকের তরে থেমে যেতে চাইত। সন্ধ্যার আগমনী বার্তা পেয়ে উদগ্রীব মশকের ঝাঁকও যেন জাদুকরের কথার মায়ায় স্থির হয়ে একজায়গায় ঘুরপাক খেত। আর ঘাসের ডগাগুলো নাচন থামিয়ে তার কথা শুনতো মনোযোগ সহকারে।
হ্যা কথার জাদু! কৈশোরের যে চঞ্চল মন কোন উপদেশের গণ্ডি মানতো না সেই মন যেন তার কথার নেশায় স্থিতিশীল মৌলের মতো স্থির হয়ে যেত। তার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ আমাদের অবাধ্য মনের ওপর সক্রিয় প্রভাবকের ন্যায় প্রভাব ফেলতো।
তিনি নানারকম উপদেশ দিতেন, বেশি বেশি বই পড়তে বলতেন। মাঝে মাঝে সবাইকে ম্যাগাজিন বা ছোট বই উপহার দিতেন পড়ার জন্য। কথাশেষে অদৃশ্য একটা ছুটির ঘণ্টার শব্দে যেন সবাই সম্বিত ফিরে পেতাম। আবার অন্যকোন দিন রঙবেরঙের কথার ঝুলি নিয়ে হাজির হওয়ার কথা দিয়ে ছুটি দিতেন। মাঝে মাঝে আপসোস হয় তখন উনার কথাগুলো যদি বাক্সবন্দি করা যেত তবে তাই করতাম। এখন বড়বেলায় বাস্তবতার মঞ্চে অভিনয়ের চক্করে সেসব কথা মস্তিষ্কের নিউরনে শত হাতড়েও পাইনা।
এতক্ষণ যে জাদুকরের কথা বলছিলাম তিনি আর কেউ নন তিনি আমাদেরই শিশির স্যার (ডঃ মীর আবু সালেহ শামসুদ্দিন শিশির)। তিনি একজন বহুমাত্রিক লেখক এবং পেশায় অধ্যাপক। শিক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি তাঁর আগ্রহের মূল বিষয় হলেও তিনি সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করতে পারেন খুব সহজে, অনায়াসে৷ চট্টগ্রামের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার নিয়মিত লেখক তিনি। এরমধ্যে অনেক বই লিখে সাড়া ফেলেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে “ম্যানার্স” বইটি আমার ভীষণ প্রিয়।
সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে তাঁর লেখার প্রতিভা এককথায় ইনফিনিটি। কিভাবে অতি সহজেই শিশু কিশোরদের মন জয় করতে হয় সে কৌশল কেবল তিনিই জানেন৷ এককথায় শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি ‘জাদুকর’। আমি নিশ্চিত যারা উনার পরম ছায়াতলে একবার আসার সুযোগ লাভ করেছে তারা খুব সৌভাগ্যবান।
শ্রদ্ধেয় স্যার আপনার চরণ সমীপে আমার এই ছোট নিবেদন।