সেকালের ঈদ, একালের ঈদ

ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই  আনন্দ। আর রোজার ঈদ, সে-তো অন্যরকম এক আনন্দ ।  তিরিশ দিন সিয়াম সাধনার পর- অনেক সাধনার চাঁদ দেখা যায় পশ্চিম আকাশে। ছেলে-বুড়ো  সবাই  আগ্রহ নিয়ে সেই  চাঁদ  দেখতে  যায়। কেউ কেউ যায় বাড়ির ছাদে, আবার যাদের সুযোগ আাছে তারা যায় খোলা মাঠে। চাঁদ  দেখলেই আনন্দে নেচে ওঠে মন। তখন  সাথে সাথে  রেডিওতে বেজে  ওঠে কাজি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সেই  গান- ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে  এলো খুশির ঈদ…’। টিভিতেও তখন দেখা যায় শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গাইছে সেই গান। চারিদিকে পটকা, আতশবাজির শব্দ সেই  আনন্দকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
আজ প্রায়  চল্লিশ বছর ধরে ঈদ উদযাপন করছি । আগে করতাম মা-বাবা, ভাই-বোনদের সাথে  আর এখন করছি স্বামী, সন্তান, শশুর-শাশুড়ীর সাথে। দুই সময়ের ঈদই দুই ধরনের আনন্দ দেয়।

আমার ছেলেবেলার ঈদের কথা বলি। আমাদের সময় তখন এত সৌখিনতা ছিল না। মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না। এত রং বেরংয়ের খাবারের  আইটেম ছিল না। সারা মাস রোজা রেখে সেই  রোজার পনেরো দিন থেকে শুরু হতো কখন বাবা বেতন পাবে বোনাস পাবে। আমাদের ঈদের জামাকাপড় কিনে দিবে। অবশেষে সেই  কাঙ্ক্ষিত দিন যখন আসতো, বাবা আমাদের সব ভাই বোনদের  সাথে করে নিয়ে যেত ঈদের শপিং করতে । তখন ঈদের জামা হতো গজ কাপড়ের । এখনকার মত এত রেডিমেড জামা পাওয়া যেত না। সবাইকে সাধ্যমত জামার কাপড়  কিনে দিত। মায়ের জন্য একটা সুতি কাপড় কিনতো। হয়তো ব্লাউজের কাপড় কেনা হতো না। আমাদের পিড়াপিড়িতে বাবা একটা লুঙ্গি, পাঞ্জাবী কিনতো।  সবাইকে নতুন জুতা কিনে দিত। 

আমাদের সে কি আনন্দ। বাসায় এসে লুকিয়ে  রাখতাম জামার কাপড়  যাতে বান্ধবীরা না দেখে ফেলে,  তাহলে তো পুরান হয়ে যাবে। মা তার সেলাই মেশিন দিয়ে  পছন্দ  মত ডিজাইন  করে  জামা বানিয়ে  দিতেন। নতুন  জুতা পড়ে বিছানার উপর  হাটতাম যাতে জুতায় ময়লা না লাগে। রোজ রাতে  মাথার কাছে  জামা জুতা নিয়ে  ঘুমাতাম আার স্বপ্ন দেখতাম কখন ঈদ আসবে আর এ গুলো পড়ে ঘুরে বেড়াবো ।

এক সময় কাঙ্ক্ষিত ঈদ আসতো। খুব ভোরে  বাবার সাথে  সব ভাইবোন  গোসল সেরে নতুন জামা জুতা  পড়ে  বাবা, মাকে সালাম করে সালামী পেতাম। তারপর বাবার সাথে  ঈদ গায়ে  যেতাম। ছেলেরা নামাজ পড়তো আর আমরা বিভিন্ন খেলা খেলতাম। সালামি দিয়ে বেলুন, খেলনা  কিনতাম। নামাজ শেষে সবাই  এর ওর সাথে  কোলাকুলি করতো। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ভার্তৃত্বের বন্ধনে সবাই  আবদ্ধ হতো।
বাসায় আম্মা সেমাই, জর্দা, লাচ্ছাসেমাই, পায়েশ আর গরুর মাংস খিচুড়ি  রান্না করতো। সবাই  একসাথে  মজা করে সেগুলো খেতাম। তারপর দলবেঁধে বান্ধবীরা এর ওর বাসায় ঘুরতে যেতাম। সবার বাসায় একটু হলেও  খেতে হতো। আবার ওরাও আমাদের বাসায় আসতো আম্মা  যত্ন করে ওদের খাওয়াতেন। সে দিন দাওয়াতের অপেক্ষা কারো থাকতো না। মেহমান দিয়ে ঘর ভরে যেত। অন্যরকম একটা দিন কাটতো। আব্বা পাশের গরীব দুঃখীদের ডেকে এনে খাওয়াতেন।

আার এখনকার ঈদ?  ছেলেমেয়েরা রং বেরংয়ের একাধিক জামা কাপড়, জুতা ব্যাগ কেনে ঠিকই; কিন্তু যার মধ্যে ওরা সেই  কাঙ্ক্ষিত আনন্দ খুঁজে পায়না। কারণ ওরা প্রায়ই নিত্য নতুন জামা কাপড় কেনে তাই ওদের কাছে  নতুন কিছু  মনে  হয়না আবার ওদের  খাবার দাবারেও পছন্দের অনেক পরিবর্তন এসেছে । যেমন সেমাই, পায়েশ বা খিচুড়ি মাংসে সেই  স্বাদ পায়না যা আমরা পেতাম। ওদের কাছে পাস্তা, নুডলস, চিকেন ফ্রাই  আর যত বিদেশি খাবার ভালো লাগে। সেই  দল বেধে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো  বা আড্ডা দিতে  পারেনা।
কারণ বর্তমানে ফ্লাট বাসা আর গেটে গেটে তালা এবং সময়ের অস্থিরতায় সেই  সুযোগ তেমন একটা হয়না। মোবাইলে ওরা ভার্চুয়াল আড্ডায়  মেতে ওঠে । যা সেকালের ঈদ  একালের ঈদে অনেক  পার্থক্য দেখা যায়। আর গরীব দুঃখী সেজে অনেকে ছল-চাতুরী  করে, এজন্য কে যে আসল গরীব সেটা বোঝাও দায়। গেটে গেটে  তালা আর দারোয়ান  থাকাতে  গরীব লোক মালিক পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেনা।
মাঝে মাঝে খুব  কষ্ট হয় ওদের  জন্য । আহ্ বাচ্চাগুলো যদি  আমাদের ছোটবেলাটা পেত তাহলে কতইনা আনন্দ পেত। খুব  মিস করি  আমার সেকালের ঈদ একালের ঈদের ভীড়ে। তারপরও  ঈদ আনন্দের, ঈদ খুশির।

 

Scroll to Top