নীলের চোখ বন্ধ, চারিদিকে নিস্তব্ধ। হাত ঘড়িটার টিক টিক শব্দের সাথে, হৃদয়ের কম্পন যেন পাল্লা দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর বৃষ্টি বিকেলে নীল বিছানায় একটা বই নিয়ে এলোমেলো কি সব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভাঙল, তার মোবাইল ফোনটা বেজে যাচ্ছে। কথা শেষ করে, দ্রুত পোশাক পাল্টে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে গেলো। নীলের একটা ব্যান্ড দল আছে, আজ প্রস্তুতির শেষ দিন। আগামীকাল ক্যাম্পাসে নবীনবরণ, পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এই দলের উপর।
চারিদিকে বৃষ্টি, ঝুম বৃষ্টিতে আজ গানের তালে মনটা বেশ ব্যাকুল। নীলের মাঝে নীল যেন তলিয়ে যাচ্ছে, আপন মনে গেয়ে যাচ্ছে …
সমুদ্রের নীল জল আকাশের সাথে মিশে যাবে,
আকাশটা নীলে নীলে আরো রঙিন হবে,
দূরের আকাশ যখন খুব কাছে টানবে,
তখন মেঘ হবে নীলের স্বপ্নের বাড়ি,
বাড়ির চারপাশটা ঘিরে থাকবে নীলপদ্ম,
ঐ নীল ঠিক ভালোবাসার নীলকে ছুঁয়ে দেবে।
বারান্দায় নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ে, নীল আনমনে জানালা দিয়ে মেয়েটিকে দেখছে। মেয়েটি এতগুলো রুম থাকতে তাদের রিহার্সাল রুমের দিকে গটগট করে হেঁটে এলো। নীলের চোখে মুখে তখন একটা লাইন “নীল ঠিক ভালোবাসার নীলকে ছুঁয়ে দেবে”, হৃদকম্পন যেন দ্বিগুণ করে দিলো। আজ সকাল থেকে নীল একদম এলোমেলো, এখন তো নিজেকে আরো বেশি এলোমেলো লাগছে। মেয়েটা কিছুদূর এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ারে বসে ফ্যানের বাতাসে চুল শুকাতে লাগলো। নীল ভাবছে আর বলছে মেয়েটা একদম ভিজে গেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে নীল খেয়াল করলো- সুমিত, বেলা, শিশির, রঞ্জন, রিমঝিম সবাই মেয়েটার দিকেই হা করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ বেলা উঠে দাঁড়িয়ে, আরে এটা নিধি না, হ্যাঁ তাই তো। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল- “ইশ, মেয়েটা এত্ত সুন্দর কেন।” বেলা ওদের মধ্যে দুষ্টুর শিরোমণি। নীল প্রায়ই বলে- এত্ত ফাজিল মেয়ে, আমি এই জীবনে দেখিনি।
নীলের জন্মদিন জানুয়ারি ২৯ তারিখ। সেদিন নিধির সাথে নীলের দ্বিতীয় বারের মতো দেখা।
উপহারের জন্য ছিল- প্রিয় ব্র্যান্ডের, একটা গিটার।
নীল সত্যি অবাক হল, নিধি কিভাবে জেনে গেলো তার পছন্দদের কথা। সেদিনটা নীল শুধু নিধিকে দেখেছে, আর ভেবেছে মেয়েটা সত্যি খুব সুন্দর। ঘুরে ফিরে নিজেকে প্রশ্ন করেছেঃ সত্যি কি এতোটা সুন্দর? নীলের ভয় হয়- দূর থেকে অনেককিছু খুব সুন্দর দেখায়, মসৃণ অনুভবে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু কাছে এলে সব এলোমেলো হয়ে যায়, অনুভূতিগুলো আড়ালে, অভিমানে ঢেকে যায়। তাই সবসময় নীল নিজেকে সামলে রাখে। কেন জানি মনে হচ্ছে- এবার আর সম্ভব হচ্ছে না। অদ্ভুত এক নেশায় নিধির নীল শাড়ির আঁচল যেন তাকে ডাকছে। দূর থেকে নিধি যেন তাকে ডাকছে ইশারায়, তার নির্মল হাসিতে। এ কেমন মন তার, বারবার হারিয়ে যাচ্ছে নিধির ঐ দুটো কাজল কালো চোখে। ভালো লাগাগুলো কি এভাবেই আঁকড়ে ধরতে চায়, চোখ ভিজিয়ে দিয়ে ভালবাসতে চায়।
নিধিকে বহুবার দেখেছে সে ভার্সিটিতে, তার বন্ধু রিমঝিমের খালাত বোন। কিন্তু তখন তো তার এতো ভাললাগেনি, তাহলে আজ কেন নিধি, নিধি জুড়ে আছে সমস্ত কথাতে। এই রুমের বদ্ধ দেয়ালে যেন লেখা আছে একটি নাম- “নিধি”। নিধি যেন একটা নিঃশ্বাসের নাম, একটা বেঁচে থাকার পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা। গিটারের কথাটা নির্ঘাত রিমধিম বলেছে নিধিকে, মেয়েটা একটা কথাও পেটে রাখতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে নীল নতুন গিটারে আঙুল চেপে সুর তুলতে চেষ্টা করে, আর তখনই গিটারটার ভেতর থেকে আরো বড় একটা উপহার আবিষ্কার করে।
একটা কবিতা, একটা নীল রঙে জড়ানো আবেগ, একটা প্রিয় মুহূর্ত। একটা অনুভূতির খেলা, একটা মায়া। কবিতাটি হাতে নিয়ে নীল সেই কাগজের গন্ধ শুঁকে নিধিকে স্পর্শ করতে চাইলো।
*** নীল সেতু
সবুজ পাতাগুলো আজ ঘুমিয়ে,
যেন সূর্য উঠলেই জেগে উঠবে,
ঘুমের মাঝে প্রস্তুতি চলে,
এই ভোর হল বলে,
প্রার্থনায় বসে পাখিদের কুজনে,
নিজের কথা গুছিয়ে সহজে,
রোদ্দুর আর পানিতে ভিজিয়ে,
সবুজের আভা বাড়িয়ে,
দীর্ঘশ্বাসের আয়ু কমিয়ে,
সবুজে সবুজে সকাল রাঙিয়ে,
তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে,
লাল শাড়িতে নীল দিগন্ত ছাড়িয়ে,
বসে আছি তোমার মন সবুজে,
অসংখ্য নীলের ঠিকানা খোঁজে,
মনের নীল সেতু স্বর্গের কাছে,
নীলের ভিড়ে চোখের মাঝে।
কবিতার ওপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল
“নীল ঠিক ভালোবাসার নীলকে ছুঁয়ে দেবে”।
সেই রাতে সবটুকু ঘুম বিছানায় এলোমেলো করে মিশিয়ে দিয়ে, ভোর হল। নতুন একটা সকাল, জীবনের নতুন একটা মানে, অনেক হারিয়ে যাওয়া চাওয়ার মাঝে একটা নতুন নাম যুক্ত হল। হাজারো মানুষের ভিড়ে একটা মানুষ একান্ত আমার আপন হল। এসব ভাবনায় যখন নীল একদম ডুবে আছে, তখন হঠাৎ সে শুনতে পেলো, দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে- একটা মেয়ে কণ্ঠ… নীল নীল।
নীল দরজা খুলে সত্যি অবাক, নিধি দাঁড়িয়ে আছে- তার গায়ে লাল একটা মসলিন শাড়ি জড়ানো। ঠিক তার কবিতার মতো। এতো মায়া, এতো স্বচ্ছতা – নীল আগে কখনো দেখেনি কারো মাঝে। রাত জাগা সমস্ত ক্লান্তি এখন নেই, নিধিকে আজ আরো বেশি মায়াবতি লাগছে। নিধিকে বসতে বলে নীল জিজ্ঞেস করলো- কি খাবে কফি না চা। উত্তরে নিধি কিছু বলল না, তবুও নীল দু’কাপ কফি নিয়ে এলো।
কফি হাতে দুজন বেল্কনিতে পাশাপাশি বসে কথা বলছে, কথা বলতে গিয়ে নিধি কাচের লাল চুড়িতে হাত নেড়ে ইচ্ছে করে রিনিঝিনি শব্দ তুলছে আর ওদিকে নীল নিজের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে মাঝে মাঝে গলা পরিষ্কার করার অজুহাতে কেশে নিচ্ছে।
তাদের কথোপকথন এগিয়ে যাচ্ছে, ঘড়ির কাঁটাও তার মতো করে টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে।
তোমার পাহাড় না সমুদ্র পছন্দ ?
– আমার সব পছন্দ, প্রকৃতির যত সবুজ, যত নীল আছে সব।
ওদের মাঝে যা আছে, তা আমার কাছে নেই। দেখলে মনটা উদাস করার মতো ভালো হয়ে যায়, ভালো লাগার উঠোন জুড়ে আনন্দ আর আনন্দ। দুচোখ ভর্তি আরাম, আরাম আর আরাম।
হুম, …………… অনেক শান্তি।
– কিন্তু এই শান্তি চোখের নিচের ক্লান্তি দূর করে,
হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো দ্রুত মিলিয়ে যায়, হারিয়ে যায়।
হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো দ্রুত মিলিয়ে যায়, হারিয়ে যায়।
দ্রুত হারিয়ে যায় বলেই তো- আমরা সেই অনুভূতিগুলোকে আবার ফিরে পেতে চাই।
– এসব অনুভূতির অনেক মূল্য, অনেক কসরত করে জয় করতে হয়।
সবার অনুভূতি, সবার শান্তির চিহ্ন তো এক নয়।
সবার অনুভূতি, সবার শান্তির চিহ্ন তো এক নয়।
আচ্ছা- “তোমার শান্তির নাম কি?”
একটা নীল আকাশ, একটা নীল রঙের শাড়ি আর নীল একটা তুমি।
– নীল একটা তুমি? তুমি টা কে?
প্রথম দিনের দেখা একটা নীল শাড়িতে যে তুমিটাকে দেখেছিলাম সেই তুমি।
আমার প্রিয় তুমি-
আমার প্রিয় তুমি-
আমার প্রেমময় নিধি।
এক স্বর্গের ভালোবাসা।
ভেজা চোখে নিধি নীলের দিকে তাকিয়ে-
বলতে শুরু করলো-
আমাকে ভালোবাসতে হবে না, ভালোবাসি বলতেও হবেনা,
মাঝে মাঝে গভীর আবেগে আমার ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিতে হবেনা,
কিংবা আমার জন্য রাত জাগা পাখি হতে হবেনা,
আমার জন্য কোন গান খাতার প্রয়োজন নেই, নেই কোন নতুন সুরের,
অন্য সবার মতো রুটিন মেপে বিকেল চারটায় দেখা করতে গিয়ে তোমাকে নিজের কাজ নষ্ট করতে বলবো না,
মোড়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলবো না, অধিকার নিয়ে প্রতিদিন ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরবো না।
তবুও,
তোমার কাছে একটি চাওয়া, একটি অনুরোধ
প্রতিদিন ফেরার পথে, তোমাকে বলবো “ভালোবাসি”
তুমি তখন অশ্রু ভেজা চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু বলবে ,
“পরী আমার।”